নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে আসা ২০১৩ ব্যাচের ১২ জন আইএএস অফিসারকে ‘ফিল্ড পোস্টিং’ দিল না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
নবান্নের একটি সূত্রের যুক্তি, বিধানসভা ভোটের আর দেরি নেই। যাঁদের ‘ফিল্ড পোস্টিং’ দেওয়া হবে, তাঁদের মূলত ভোটের কাজই করতে হবে। কিন্তু এই নতুন অফিসাররা একেবারেই অভিজ্ঞ নন। বিশেষ করে ভোট করানোর অভিজ্ঞতা তো তাঁদের একেবারেই নেই। এই অবস্থায় তাঁদের বিভিন্ন মহকুমার দায়িত্বে পাঠিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তার চেয়ে ওই সব জায়গায় অভিজ্ঞ অফিসারদের পাঠানোর সিদ্ধান্তই সঠিক। এই অংশের মতে, ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন ভোট প্রক্রিয়া পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা। না হলে নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে।
প্রশাসনের অন্য একটি অংশ অবশ্য এই যুক্তি উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের দাবি, আসলে নতুন আইএএস অফিসারদের রাজনৈতিক অবস্থান কী, তা এখনও রাজ্য সরকারের কাছে স্পষ্ট নয়। তার উপরে এখানে কাজে যোগ দেওয়ার কিছু দিন আগে পর্যন্ত ওই সব অফিসারদের কেন্দ্রের বিভিন্ন দফতরে রেখে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যাকে মোদীর ‘মগজধোলাই’ বলেই মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী। সে কারণেই এই অফিসারদের ‘ফিল্ড পোস্টিং’ দিয়ে ভোট পরিচালনার কাজে নিয়োগ করতে চাননি তিনি।
অতএব, অপেক্ষাকৃত ‘চেনা’ অফিসারদের উপরেই স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনার ভার তুলে দিতে চলেছেন রাজ্যের কর্তারা। নবান্নের খবর, সবে মাত্র কাজে যোগ দেওয়া ওই ১২ জন আইএএস অফিসারকে মহকুমা শাসক পদে না-বসিয়ে বিভিন্ন দফতরে ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) পদে নিয়োগ করা হয়েছে। আর মহকুমাশাসকের শূন্য পদে আনা হয়েছে বাছাই করা সিনিয়র ডব্লিউবিসিএস অফিসারদের। এঁদের ‘দক্ষতা’ নিয়ে নিঃসংশয় নবান্ন।
প্রশ্ন উঠেছে, আইএএস-দের চাকরি জীবনের প্রথম কাজের ক্ষেত্র কি মহকুমা শাসকের মতো ‘ফিল্ড পোস্টিং’ হতেই হবে?
সরকারের এক শীর্ষকর্তা জানান, কাজে যোগ দেওয়ার পরে আইএএস অফিসারদের কোথায় নিয়োগ বা বদলি করা হবে— তা ঠিক করে সংশ্লিষ্ট রাজ্য প্রশাসন। তবে গোটা দেশে চালু প্রথা হল, আইএএস অফিসারেরা কাজে যোগ দিলে তাঁদের প্রথমে মহকুমাশাসকের মতো ‘ফিল্ড পোস্টিং’-এ পাঠানো হয়। এ রাজ্যেও তেমনটাই দস্তুর। এ বার ব্যতিক্রম হল।
অথচ, আগামী এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই বিধানসভা ভোট হবে অসম, তামিলনাড়ু, কেরল এবং পুদুচেরিতে। এর মধ্যে কেরলে প্রশিক্ষণ শেষ করে কাজে যোগ দেওয়া পাঁচ জন আইএএস অফিসারকেই সহকারী-কালেক্টরের ‘ফিল্ড পোস্টিং’ দেওয়া হয়েছে। তামিলনাড়ুতে ২০১৩ ব্যাচের ন’জন অফিসারকে মহকুমা শাসক পদে বসানো হয়েছে। অসমে সাত জনের মধ্যে দু’জনকে ইতিমধ্যে ‘ফিল্ড পোস্টিং’ দেওয়া হয়েছে। বাকিদের বিভিন্ন দফতরে নিয়োগ করা হয়েছে। অসম প্রশাসন সূত্রের খবর, ওই আইএএস অফিসারদের ‘ফিল্ড পোস্টিং’-এ পাঠানোর মতো পদ খালি নেই। পদ খালি হলে ওই অফিসারদেরও সেখানে পাঠানো হবে।
প্রশাসন সূত্রের খবর, এই নতুন আইএএস-দের নিয়োগের আগে দিল্লিতে তাঁদের প্রশিক্ষণকে কেন্দ্র করে মমতার সঙ্গে কেন্দ্রের লড়াই চরমে উঠেছিল। কেন্দ্রের যুক্তি ছিল, আইএএস-রা রাজ্যে গিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার আগে প্রত্যেকের কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের কাজ বুঝে নেওয়ার প্রাথমিক প্রশিক্ষণটুকু থাকা দরকার। তাতে ঘোরতর আপত্তি ছিল মমতা প্রশাসনের। নবান্নের বক্তব্য ছিল, কেবল মাত্র মগজধোলাই করতেই ভোটের মুখে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নের কাজ বাদ রেখে প্রশিক্ষণের যুক্তি সাজিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর।
এই পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে জানান, ওই ১২ জন অফিসারকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশিক্ষণে পাঠানোই হবে না! তাঁরা বিভিন্ন মহকুমার দায়িত্ব নিয়ে রাজ্যের উন্নয়নের কাজ করবেন। এই নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে রীতিমতো আকচাআকচি শুরু হয়। কেন্দ্রীয় কর্মিবর্গ (পার্সোনেল) মন্ত্রক পাল্টা জানায়, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া সব রাজ্যের অফিসার প্রশিক্ষণে যোগ দিয়েছেন। তাই পশ্চিমবঙ্গের ক্যাডাররা না-এলে ফল ভুগতে হবে রাজ্যকে। এর পরেই ওই ১২ জনকে দিল্লি পাঠাতে রাজি হন মুখ্যমন্ত্রী।
কেন্দ্রীয় সরকারের এক কর্তা জানান, ইউপিএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় হাজার খানেক অফিসার নিয়োগ করে দিল্লি। আইএএস, আইপিএস, আইএফএস, আইআরএস-এর মতো বিভিন্ন কেন্দ্রীয় স্তরের গ্রুপ-এ অফিসারদের দীর্ঘ প্রশিক্ষণ পর্ব চলে মূলত মুসৌরি, ভোপাল, নাগপুর, হায়দরাবাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এদের মধ্যে আইএএস, আইপিএস এবং আইএফএস অফিসারদের চার মাসের প্রথম পর্বের প্রশিক্ষণ হয় মুসৌরির লালবাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে।
প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পর্বের পর অফিসারদের দু’মাস ধরে সারা দেশে ঘোরানো হয়। ‘ভারত দর্শন’ নামে এই পর্বের পর আইএএস-দের ১৫ সপ্তাহের বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য ফের মুসৌরি যেতে হয়। এই সময়েই অফিসারদের ক্যাডার নির্বাচন করা হয়। অর্থাৎ, কোন অফিসার কোন রাজ্যে গিয়ে কাজ করবেন। সেই মতো সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ভাষা শেখানোর কাজও চলে। তার পর আট মাসের জন্য ওই অফিসারেরা রাজ্যে রাজ্যে চলে যান তৃণমূলস্তরে কাজ শেখার জন্য। শেষ লগ্নে তাঁদের ছয় সপ্তাহের জন্য ফের মুসৌরি গিয়ে চূড়ান্ত পর্বের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। তার পরেই তাঁরা ক্যাডার স্টেট–এ কাজে যোগ দেন।
কেন্দ্রীয় কর্মিবর্গ মন্ত্রক এ বার ওই প্রক্রিয়ায় বদল এনেছে। ২০১৩ ব্যাচের ১৮৭ জন আইএএস-এর মুসৌরির প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছরের অগস্টে। তার পরেই তাঁদের রাজ্যে রাজ্যে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে সময় প্রধানমন্ত্রীর দফতর জানিয়ে দেয়, ২০১৩ ব্যাচের অফিসারদের তিন মাসের জন্য দিল্লি আসতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রকে তাদের সচিবালয়ের কাজ শেখার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। সেই লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে সহকারী সচিবের পদও তৈরি হয়। এই প্রশিক্ষণ নিয়েই প্রশ্ন তুলে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
নবান্নের একাধিক কর্তার বক্তব্য, কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ আটকাতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু নতুন অফিসারদের হাতে-কলমে কাজ শেখার ‘ফিল্ড পোস্টিং’ বন্ধ করে দিলেন প্রথা ভেঙে। এটা খারাপ নজির হয়ে থাকল।