কৈলাস বিজয়বর্গীয়র সঙ্গে দেখা করে শোভনরা ‘নিষ্কৃতি’ চেয়েছেন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কোনও মূল্যেই আর বইবেন না ‘অসম্মানের’ বোঝা। তাই বিজেপিতে যোগ দেওয়ার দু’সপ্তাহের মাথায় দলীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে ‘নিষ্কৃতি’ চাইলেন শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপির অন্যতম সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়র সঙ্গে দেখা করে শোভনরা ‘নিষ্কৃতি’ চেয়েছেন। প্রয়োজনে আনুষ্ঠানিক ভাবে ইস্তফা দিতেও প্রস্তুত— বিজয়বর্গীয়কে শোভন এ কথাও জানিয়েছেন।
বিজেপিতে তাঁদের যোগদানের দিন থেকে অর্থাৎ ১৪ অগস্ট থেকে শুরু করে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত অর্থাৎ ২৮ অগস্ট রাত পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ যে পথে এগিয়েছে, তাতে নিজেদের অসম্মানই দেখছেন শোভন-বৈশাখী। রায়দীঘির তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায়কে বিজেপিতে শামিল করা বা না করা সংক্রান্ত চৰ্চা এখন তুঙ্গে। সেই চৰ্চা যে দিকে গড়িয়েছে, তাতে শোভন মোটেই সন্তুষ্ট নন। শুধুমাত্র বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপে পড়েই দেবশ্রী রায়ের বিষয়ে আপত্তি তুলতে শোভন বাধ্য হয়েছেন, দেবশ্রীর বিষয়ে শোভনের নিজের কোনও আপত্তি ছিল না— এই রকম একটা তত্ত্ব রাজ্য বিজেপির একটি অংশ থেকেই খাড়া করার চেষ্টা চলছে বলে শোভন মনে করছেন। রাজ্য বিজেপির এক সহ-সভাপতি সেই তত্ত্বকে বিশেষ ভাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলেও শোভন খবর পেয়েছেন। তাতে শোভন বিরক্ত তো বটেই। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদনের বিরোধিতা কেন করল না দল, সে প্রশ্নও গত কয়েক দিনে খুব বড় হয়ে উঠেছে কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের কাছে। তাই বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত হওয়া বৈঠকে দলের কাছ থেকে শোভন নিষ্কৃতি চেয়ে নিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টার পরে কৈলাস বিজয়বর্গীয়র দক্ষিণ কলকাতার আবাসে ডাক পড়েছিল শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তার আগের রাতেই শোভনের বাড়ি গিয়ে বৈঠক করেছিলেন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফ থেকে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পর্যবেক্ষক অরবিন্দ মেনন। সঙ্গে ছিলেন জয়প্রকাশ মজুমদারও। মেননের সঙ্গে শোভন-বৈশাখীর সম্পর্ক বেশ ভাল হলেও জয়প্রকাশের নানা ভূমিকা সম্পর্কে তাঁরা দু’জনেই সন্দিহান। বুধবার রাতে শোভনের বাড়িতে হওয়া বৈঠকে জয়প্রকাশ রীতিমতো তোপের মুখে পড়েন বলেও বিজেপি সূত্রের খবর। তবে প্ৰাক্তন মেয়রের ঘনিষ্ঠ মহল জানাচ্ছে, এই টানাপড়েন শোভন আর জিইয়ে রাখতে চান না। তাই বৃহস্পতিবার রাতে বিজয়বর্গীয়কে শোভন অনুরোধ করেছেন, তাঁকে ও বৈশাখীকে দল থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হোক।
আরও পড়ুন: মানুষ মরে মরুক, শেষমেশ রাজ্যটা তো আমাদের হবে!
মূলত যে কারণে তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়েছিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়, বিজেপিতে যোগদানের পরেও সেই একই পরম্পরা চলছে বলে শোভন মনে করছেন। সমস্ত ঘটনা পরম্পরা জানা সত্ত্বেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে বেঠিক ভাবে জনসমক্ষে উপস্থাপন করছিলেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব— এমনই অভিযোগ ছিল শোভনের। তাঁর ‘বিপদের বন্ধু’ তথা ‘পরিপূরক’ বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কেও তৃণমূল অপমান করছিল বলে শোভন মনে করছিলেন। তাই ২০১৮-র ২০ নভেম্বর মন্ত্রিত্বে ও মেয়র পদে ইস্তফা দিয়ে তৃণমূলের যাবতীয় কার্যকলাপ থেকে শোভন নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। দলের তরফে একাধিক বার তাঁর মান ভাঙানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। ২০১৯-র ১৪ অগস্ট তিনি ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিতে যোগ দেন।
বিজেপিতে যোগদানের দিন।
বিজেপিতে যোগদানের সময়ে এবং তার পরে শোভন সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘‘কোনও শর্ত দিয়ে এই দলে যোগদান করছি না। কোনও পদ চাইছি না। শুধু মর্যাদার সঙ্গে রাজনীতিটা করতে চাইছি।’ কিন্তু গেরুয়া দলের ১৫ দিন কাটতে না কাটতেই শোভনের মনে হয়েছে, ‘মর্যাদা’র সঙ্গে কাজ করা কঠিন হচ্ছে। তৃণমূলে যা ঘটছিল, বিজেপিতেও পরিস্থিতি ঠিক সে দিকেই গড়াচ্ছে বলে তাঁর মত। সেই কারণেই তিনি দলের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে নিয়েছেন বলে শোভন ঘনিষ্ঠদের দাবি।
আরও পড়ুন: সরকারের দাওয়াই দশের বদলে চার, ফের জুড়ছে ব্যাঙ্ক
ঠিক কী ঘটেছে বৃহস্পতিবার রাতের বৈঠকে? বিজেপি সূত্রের খবর, সে বৈঠকে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বেশ কিছু কঠোর শব্দ ব্যবহার করেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়। তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায়কে বিজেপিতে স্বাগত জানানোর পথে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়-ই বাধা সৃষ্টি করছেন, শোভনের আসলে কোনও আপত্তি নেই— এই রকম খবর তিনি পেয়েছেন বলে কৈলাস সে বৈঠকে জানান। ‘বৈশাখীর বাধা’ মানা হবে না, এই বার্তাও কৈলাস দিয়ে দেন বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে রাজ্য বিজেপির অনেকেই সন্তুষ্ট নন— এ রকম কথাও বঙ্গ বিজেপির পর্যবেক্ষক সে দিন বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে খবর।
দিলীপ ঘোষের সঙ্গে বিজেপি দফতরে শোভন-বৈশাখী।
এই ‘কঠোর বার্তা’ কিন্তু পরিস্থিতিকে কৈলাসের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। বরং উল্টো ফল হয়। বৈশাখী নিজে তো বিজেপি ছেড়ে দেওয়ার কথা কৈলাসকে জানিয়ে দেনই। শোভনও বলে দেন যে, বৈশাখীর অসম্মান সহ্য করে তিনি বিজেপির হয়ে কাজ করতে পারবেন না। দেবশ্রী রায়কে বিজেপিতে স্বাগত জানানোর প্রশ্নে তাঁর ও বৈশাখীর অবস্থান ভিন্ন, এমনটা ভাবার কোনও কারণ যে নেই, তা-ও কৈলাসকে বুঝিয়ে দেন শোভন। বৈঠকের শেষে কৈলাসকে শোভন বলেন, তাঁকে ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে যদি সত্যিই সমস্যা হয়, তা হলে তাঁরা আর বিজেপির বিড়ম্বনা বাড়াতে চান না, তাঁদের নিষ্কৃতি দেওয়া হোক। দল চাইলে অনুষ্ঠানিক ভাবে ইস্তফা দিয়ে নিষ্কৃতি নিতেও আপত্তি নেই, জানিয়ে দেন শোভন।
আরও পড়ুন: ঝিমুনিতে দেশের অর্থনীতি, বৃদ্ধির হার ৫%, ছ’বছরে সর্বনিম্ন
বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত চলে এই বৈঠক। বৈঠকটির বিষয়ে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের তরফে কেউ আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ খোলেননি। তবে শোভন চট্টোপাধ্যায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আনন্দবাজারকে শোভন বলেছেন, ‘‘হ্যাঁ আমি নিষ্কৃতি চেয়েছি। অমর্যাদা বা অসম্মানের সঙ্গে আপস করব না বলেই তো তৃণমূল ছেড়েছিলাম। এখন আবার যদি একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তা হলে সরে দাঁড়ানোই ভাল।’’ শোভনের কথায়, ‘‘আমি যে বার বার বলি, আমি ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় পরস্পরের পরিপূরক, সেটা কিন্তু কথার কথা নয়। বৈশাখীর অমর্যাদা, আমারও অমর্যাদা।’’ কিন্তু ঠিক কোন ‘অমর্যাদা’র কথা শোভন বলছেন? বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত হওয়া বৈঠকে বৈশাখীকে কৈলাস যা-ই বলে থাকুন, সে কথা তো তিনি সর্বসমক্ষে বলেননি। শোভনের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা যাচ্ছে, সমস্যা শুধু কৈলাসের কঠোর মন্তব্য নিয়ে নয়। দেবশ্রী রায়কে কেন্দ্র করে যা চলছে, শোভনের আপত্তি সেখানেও। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বেশ কিছু প্রতিবেদন নিয়েও শোভনের আপত্তি রয়েছে বলে খবর। দল সেই সব বিতর্ক নস্যাৎ করে বৈশাখীর পাশে দাঁড়াক, এমনটা শোভন চাইছিলেন। কিন্তু তা এখনও হয়নি। শোভনের কথায়, ‘‘কিছুই তো চাইনি। কোনও পদ চাইনি, কোনও বিশেষ দায়িত্ব চেয়ে নিইনি। শুধু মর্যাদা আর সম্মানের সঙ্গে রাজনীতি করতে চেয়েছি। সেটাও না থাকলে কাজ করা কঠিন।’’
তাঁর ও বিজেপির মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ই করেছিলেন— বৃহস্পতিবার রাতে কৈলাস বিজয়বর্গীয়কে এ কথা মনে করিয়ে দেন শোভন। সেই বৈশাখীকে কেন এখন ‘অপমানিত’ হতে হবে? সে প্রশ্নও তোলেন। বিজেপি সূত্রের খবর, বৈঠকের শেষে কৈলাস আশ্বাস দেন যে, সব সমস্যা কয়েক দিনের মধ্যে মিটে যাবে। কিন্তু শোভন-বৈশাখী সে বিষয়ে খুব একটা আশাবাদী নন। আজ রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বের সঙ্গে কলকাতার ত্রিপুরা ভবনে সৌজন্য বৈঠক করবেন দলের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) রামলাল। এই রামলালের সঙ্গে বৈঠকের পরেই বিজেপিতে যোগদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শোভন-বৈশাখী। শনিবার সন্ধ্যায় ত্রিপুরা ভবনের বৈঠকে শোভন ডাক পেয়েছেন। কিন্তু বৈশাখী আমন্ত্রিত নন। তাই দু’জনের কেউই সে বৈঠকে যাচ্ছেন না।
বৈঠকে না যেতে পারার কারণ সম্পর্কে অবশ্য অন্য কথা জানাচ্ছে শোভনের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত। ব্যক্তিগত কাজে শুক্রবার রাতেই শোভন-বৈশাখী দিল্লি গিয়েছেন, তাই শনিবার সন্ধ্যায় কলকাতার বৈঠকটিতে শোভন থাকতে পারছেন না। দাবি শোভন ঘনিষ্ঠদের। শোভন নিজে এ বিষয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু বৈশাখী ইঙ্গিত দিয়েছেন। রামলালের সৌজন্য বৈঠকে কি তাঁর ডাক পাওয়া উচিত ছিল? এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব বৈশাখী এড়িয়ে যান। তবে তিনি বলেন, ‘‘বাবার কাছে মেয়ে যেমন স্নেহ পায়, আমি রামলালজির কাছে সেই রকমই স্নেহ পেয়েছি। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারলে ভালই লাগত। তবে বিজেপির নিজস্ব কর্মসূচি। ওঁরা কাকে ডাকবেন, কাকে ডাকবেন না, সেটা ওঁরাই স্থির করবেন। আমার কিছু বলার নেই।’’
এ প্রসঙ্গে রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বলেছেন, ‘‘সম্পর্ক যদি বাবা-মেয়ের মতোই হয়, তা হলে নিমন্ত্রণের অপেক্ষা করা উচিত নয়।’’ রাজুর কথায়, ‘‘যে রকম সম্পর্কের কথা তিনি বলছেন, সেটা তো প্রায় পারিবারিক ব্যাপার। দল সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারবে না।’’
শুধু রামলালের বৈঠকে ডাক না পাওয়ার প্রসঙ্গে নয়, দেবশ্রী রায় প্রসঙ্গেও কিন্তু এ দিন একই রকম নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বৈশাখী। আনন্দবাজারকে তিনি বলেছেন, ‘‘যাঁদের দল, তাঁরাই স্থির করবেন, কাকে নেবেন, কাকে নেবেন না। আমার কিছু বলার থাকতে পারে না।’’ এই মন্তব্যের অর্থ কী? বিজেপি-কে কি আর নিজের দল মনে করছেন না কলেজ শিক্ষিকা? দিল্লি থেকে ফোনে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি কারও বিড়ম্বনা বাড়াতে চাই না। আমার জন্য যদি সংগঠনে সমস্যা দেখা দেয়, তা হলে আমার সরে যাওয়াই ভাল।’’ কিন্তু শোভন চট্টোপাধ্যায়? ‘বিপদের বন্ধু’র পাশে দাঁড়াতে তিনিও কি সরেই যাচ্ছেন? বৈশাখীর জবাব, ‘‘তিনি সরবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন। তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আমি কখনও হস্তক্ষেপ করি না। এক বারই করেছিলাম। তাঁকে রাজনীতিতে ফিরে আসতে বলেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, সেটাই দুর্ভাগ্যজনক হল।’’