পুজোর মরসুমেও এমনই ছবি দার্জিলিং ম্যালের। —নিজস্ব চিত্র।
দার্জিলিং মেলে এলাম, কিন্তু দার্জিলিংই যেতে পারলাম না! নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে এমন আক্ষেপই ঝরে পড়ল পর্যটকদের গলায়।
মঙ্গলবার এনজেপি স্টেশনে নেমে দক্ষিণেশ্বরের শতাব্দী ঘোষ হাজরা, টালিগঞ্জের সিদ্ধার্থ দত্ত বা ঢাকুরিয়ায় মৌসম চক্রবর্তীরা কেউ চললেন ডুয়ার্সের জঙ্গলে, কেউ সিকিমের পাহাড়ে। তবে কাঞ্চনজঙ্ঘায় ঘেরা শৈলশহরের ছবি মন থেকে মুছতে না পেরে, স্টেশনে নেমে শেষবারের মতো পরিস্থিতি জানতে কেউ সংবাদপত্রে চোখ বোলালেন, কেউ গাড়ির চালক, পুলিশের কাছে খোঁজও করলেন। স্টেশনে দাঁড়িয়েই শতাব্দীদেবী বললেন, ‘‘পাহাড়টা বরাবর আমার দ্বিতীয় বাড়ির মতো। এ বার নেওড়া ভ্যালিতে যেতাম। নিরাপত্তার অভাবে যেতে পারলাম না। খুব মন খারাপ করছে।’’ মন খারাপ ম্যাল লাগোয়া তারকা হোটেলের ম্যানেজার, হকার থেকে টাট্টু ঘোড়ার মালিকদেরও। টানা তিন মাস বন্ধ-আন্দোলনে পর্যটনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিনয় তামাঙ্গ-অনীত থাপা জুটিকে সামনে রেখে যাঁরা পুজোয় অল্প হলেও ব্যবসা হবে ভেবেছিলেন, তাঁদেরও মাথায় হাত।
মঙ্গলবার রাতে বিমল গুরুঙ্গ বন্ধ ‘প্রত্যাহারের’ ঘোষণা করলেও তাতে তেমন হাল ফেরার আশা দেখছেন না বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই। সুনীল তামাঙ্গ, প্রেমা লিম্বুদের মতো ফুটপাতের গরম পোশাক বিক্রেতারা বললেন, ‘‘গত বছর মহালয়ার দু’দিন পর থেকেই দার্জিলিঙে পা ফেলার জায়গা ছিল না। এ বার গরমেও খুবই ভাল ব্যবসা হয়েছে। সেখানে ষষ্ঠীর দিন পর্যটকশূন্য।’’ একজন বলেই ফেললেন, ‘‘সেই যখন বন্ধ তুললেন, কয়েকদিন আগে তুললে পুজোর মরসুমটা তো বাঁচত।’’
ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অব নর্থ বেঙ্গলের (ফোসিন) আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী, ১০৩ দিন ধরে বন্ধের ফলে পাহাড়ের চা, পর্যটন-সহ নানা ক্ষেত্র মিলিয়ে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। মহালয়া থেকে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত পর্যটন ব্যবসা মার খাওয়ায় অন্তত ৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হতে চলেছে শুধু দার্জিলিঙের।
ফোসিনের সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘‘পাহাড়ে ফি পুজোয় অন্তত ৫০ হাজার পর্যটকের আনাগোনা থাকে। গড়ে রোজ পর্যটনে যুক্তরা যা আয় করেন তার পরিমাণ সব মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা। সেই হিসেবে মহালয়া থেকে লক্ষ্মীপুজোর তিন দিন পর অবধি ধরলে ২০ দিনে বিপুল অঙ্কের ক্ষতির আশঙ্কা।’’
কালিম্পঙের রিসর্টের ম্যানেজার রিমা শেরপা, কার্শিয়াঙের হোম স্টের মালিক নির্মল লামাদেরও মন ভাল নেই। পাহাড় নিয়ে আলোচনা শুরুর পরে ধীরে ধীরে পাহাড়ে গাড়ি চলাচল করায় কলকাতার জনা পঞ্চাশেক পর্যটককে অভয় দিয়েছিলেন ওঁরা। কিন্তু রবিবার ফের বিমল গুরুঙ্গের ফতোয়ার পরে পাহাড়ে কয়েকটি গাড়িতে হামলার জেরে ভয়টা ফের জাঁকিয়ে বসেছে। নির্মল বললেন, ‘‘টুকটাক গাড়ি চলছে বলেই যাদবপুরের একটা ট্রেকিং দলকে আসতে বলেছিলাম। মনে হয় ওঁরা আর আসার ঝুঁকি নেবেন না।’’ পর্যটন ব্যবসায়ী সম্রাট সান্যালের আশঙ্কা, ‘‘দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে পাহাড়ের পর্যটনে যুক্ত অনেকেই পেশা পাল্টাতে বাধ্য হবেন।’’
আশঙ্কার সুর বাতাসিয়া লুপের কাছে হেমা লেপচার গলাতেও। বন্ধ মোমোর দোকানের সামনে ছোট্ট মেয়ে কোলে হেমা বললেন, ‘‘আর ক’দিন দেখে সিকিমে বোনের বাড়িতে চলে যাব। সেখানে জায়গা পেলে একটা খাবারের দোকান করব।’’
সহ প্রতিবেদন: কৌশিক চৌধুরী