তিন বছর পেরিয়ে গেলেও তৃতীয় লিঙ্গের উন্নয়নে কার্যত কোনও কাজ করেনি ‘ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ড’। আজ, মঙ্গলবার থেকে শুরু হতে চলেছে সাহিত্য অকাদেমি আয়োজিত রাজ্যের প্রথম ‘ট্রান্সজেন্ডার পোয়েট্রি মিট’। তার আগেই এমন অভিযোগ তুললেন বোর্ডের একাধিক সদস্য।
রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ডের ভাইস-চেয়ারপার্সনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন বোর্ডের অন্যতম সদস্য রঞ্জিতা সিংহ। তাঁর অভিযোগ, এত বড় এক আয়োজনের কথা রাজ্যের তৃতীয় লিঙ্গের অধিকাংশ মানুষই জানতে পারলেন না। অথচ রাজ্যের ছ’জনকে বেছে তাঁদের সংস্কৃতি জগতের শ্রেষ্ঠের শিরোপা দিতে চলেছে সাহিত্য অকাদেমি। আরও অভিযোগ, সাহিত্য অকাদেমির সদস্য হওয়ায় রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ডের ভাইস–চেয়ারপার্সন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের ঘনিষ্ঠ কয়েক জনের নাম সুপারিশ করেছেন এই পুরস্কারের জন্য। রাজ্যে কি আর কেউ নেই যাঁরা এই সম্মান পেতে পারতেন, প্রশ্ন তাঁর।
শুধু তা-ই নয়। তাঁর আরও অভিযোগ, দেশের মধ্যে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ড তৈরি হয়েছিল এ রাজ্যে। জুলাই মাসেই তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে সেই বোর্ডের। অথচ তৃতীয় লিঙ্গের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কোনও কাজই করেনি বোর্ড। উল্টে বোর্ডের ভাইস-চেয়ারপার্সন নিজের ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কাজ করেননি। তাই অনেকে এখনও পড়াশোনার জন্য লড়াই করে এগোলেও কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ পাচ্ছেন না তাঁরা।
শুধু কর্মক্ষেত্র নয়। অভিযোগ, সরকারি হাসপাতাল থেকে শুরু করে কোথাও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য কোনও ব্যবস্থা নেই। সরকারি হাসপাতালে গেলে যাঁরা রূপান্তরিত মহিলা কিংবা পুরুষ নন, সেই সব মানুষের জন্য যে আলাদা ব্যবস্থা প্রয়োজন, এখনও বোর্ড তার জন্য সরকারকে সুপারিশ করেনি। তাই তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলি হাসপাতালে গেলে কোনও চিকিৎসা পান না। এঁদের জন্য রাস্তার শৌচালয়গুলিতেও যে বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে— তারও সুপারিশ পুরসভার কাছে রাখেনি বোর্ড। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন পেনশনটুকুও পান না। এমনকি, কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তা আলোচনার মধ্যেই থেকে গিয়েছে। বাস্তবে কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ। এর মধ্যেই কবিতা সভার আয়োজন হচ্ছে। রঞ্জিতার কথায়, ‘‘বোর্ড তিন বছরে আমাদের এগোতে সাহায্য করার প্রচেষ্টা করেনি। এ দিকে, ট্রান্সজেন্ডার পোয়েট্রি মিট করে অগ্রগতির কথা বলা হচ্ছে!’’
শুধু রঞ্জিতা নন। মিট নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বোর্ডের আর এক সদস্য অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, ‘‘তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজনের পড়াশোনার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা, কর্মসংস্থান— সামগ্রিক উন্নয়ন দরকার। অথচ তা না করে শুধু পোয়েট্রি মিট করে কয়েক জনকে পুরস্কৃত করা মানে তৃতীয় লিঙ্গের বাকিদের অবজ্ঞা করা।’’
বোর্ডের সদস্যদের পাশাপাশি বোর্ডের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রূপান্তরিত নৃত্যশিল্পী শ্রেয়া কর্মকার বলেন, ‘‘বোর্ডের ভাইস-চেয়ারপার্সন শুধুমাত্র লিঙ্গ পরিবর্তন করা মহিলা-পুরুষকে ট্রান্সজেন্ডার বলছেন। ফলে যাঁরা লিঙ্গ পরিবর্তন করেননি, তাঁদের সমস্যা বুঝবেন কী করে?’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা নিজেরা লড়াই করে এগোচ্ছি। বোর্ড সাহায্য করেনি বা করে না। প্রত্যন্ত এলাকার লোকেরা তো বোর্ড কী, তা-ই জানেন না। ফলে বোর্ড গড়া কী কারণে, তা-ই বুঝতে পারি না।’’
যদিও অভিযোগ মানতে রাজি নন বোর্ডের ভাইস-চেয়ারপার্সন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছেন, মিটের সঙ্গে বোর্ডের কোনও সম্পর্ক নেই। ‘‘সাহিত্য অকাদেমির সদস্য হওয়ায় আমি এর মধ্যে রয়েছি,’’ বলছেন তিনি। কিন্তু পোয়েট্রি মিট-এর খবর কি রাজ্যের তৃতীয় লিঙ্গের সব মানুষের কাছে পৌঁছেছে? তার দাবি, ‘‘যাঁরা সংস্কৃতি চর্চা করেন, তাঁদের আমি চিনি। তাঁরাই আসছেন মিটে।’’ আর বোর্ডের কাজ? মানবী বলেন, ‘‘বোর্ড গত তিন বছরে অনেক কাজ করেছে। কিন্তু যাঁরা শুধু সমালোচনা করেন, তাঁরা তা দেখতে পান না।’’