কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে যত্রতত্র বেআইনি নির্মাণ নিয়ে বারবার পুরসভাকে সতর্ক করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হয়নি। অবৈধ নির্মাণের ব্যাপারে উদাসীনতা কেন, সেই প্রশ্ন তুলে পুর-কর্তৃপক্ষকে কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করলেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর। ‘‘বেআইনি নির্মাণ ভাঙেননি কেন? আপনার উপরে কারও চাপ ছিল কি,’’ শুক্রবার একটি জনস্বার্থ মামলায় কলকাতার পুর কমিশনার খলিল আহমেদকে প্রশ্ন করেন তিনি।
মামলাটি হয়েছে কাশীপুর রোডে সরকারি ঠিকা জমিতে বস্তি ভেঙে চার বা পাঁচতলা পাকা বাড়ি নির্মাণ নিয়ে। পুর আইন অনুসারে এই ধরনের নির্মাণকাজ পুরোপুরি বেআইনি। পুরসভার অনুমতি নিয়ে তেতলা পর্যন্ত নির্মাণ আইনসম্মত। কেবল কাশীপুর রোডের ওই জায়গাটিই নয়, পুরসভা-কর্তৃপক্ষ সতর্ক থাকলে এবং ঠিকঠাক নজরদারি চালালে শহরের যত্রতত্র বেআইনি নির্মাণের এত রমরমা হতে পারত না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি চেল্লুর।
পুরসভার আইনজীবী অলোক ঘোষের কাছে প্রধান বিচারপতি এ দিন জানতে চান, কাশীপুরে এমন বেআইনি নির্মাণের দাপট কেন? এর মোকাবিলায় পুর-কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? অলোকবাবু জবাব দেন, ‘‘থানায় এফআইআর করা হয়েছে।’’ এফআইআর পড়ে আর এক প্রস্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন প্রধান বিচারপতি। মন্তব্য করেন, ‘‘কী লজ্জার কথা! অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নিছক নোটিস পাঠিয়েই দায়দায়িত্ব শেষ!’’
বেআইনি নির্মাণ হয়েছে জেনেও তা না-ভাঙার যে-ব্যাখ্যা পুরসভা দিয়েছে, তা লোকদেখানো বলেও মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি। পুর কমিশনার খলিল আহমেদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আপনি জবাব দিন,
এর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন।’’
জবাবে পুর কমিশনার বলেন, ‘‘অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে দেড় মাস সময় লাগবে।’’ শুনেই আবার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি। বলেন, ‘‘ন’মাস সময় পেয়েও কাজ করতে পারলেন না?’’
বেআইনি নির্মাণ না-ভাঙায় প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন কলকাতা পুরসভার এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকেও ভর্ৎসনা করেছে। পুরসভাকে ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ, কাশীপুর রোডের বেআইনি নির্মাণ ভাঙার ব্যাপারে কী অগ্রগতি হয়েছে, ১৫ দিনের মধ্যে আদালতকে তা জানাতে হবে। যে-সব পুরকর্মী ওই বেআইনি নির্মাণে মদত দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই বা কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ডিভিশন বেঞ্চ তা-ও জানানোর নির্দেশ দিয়েছে।
পুরসভা সূত্রের খবর, ৯৬ এবং ৯৯ নম্বর কাশীপুর রোডে সরকারি ঠিকা জমিতে বস্তির ঘর ভেঙে ওই সব পাকা বাড়ি গড়ে ওঠে বছরখানেক আগে। পুরসভা কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এই অভিযোগ তুলে মণিপ্রসাদ সিংহ নামে এলাকার এক বাসিন্দা প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। তাঁর আইনজীবী উদয়শঙ্কর ভট্টাচার্য এ দিন বলেন, ‘‘পুরসভার অনুমতি ছাড়াই চার-পাঁচ তলা বাড়ি তৈরি হয়েছে।’’ মামলার আবেদনে বলা হয়, বেআইনি নির্মাণের বিষয়টি মেয়র এবং পুর কমিশনারকেও জানানো হয়েছিল। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।
গত ২২ জুলাই এই মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ মন্তব্য করেছিল, কাশীপুর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা আদৌ রয়েছে কি না, সেটা জানা দরকার। সে-দিনই পুর কমিশনারকে নির্দেশ দেওয়া হয়, ২৯ জুলাই আদালতে হাজির হয়ে জানাতে হবে, বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে এ-পর্যন্ত কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
পুরসভার আইনজীবী এ দিন বলেন, ‘‘বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে পুলিশের সাহায্য দরকার। তারা সময়মতো সাহায্য না-করলে কাজ হয় না।’’ তা শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘পুর কমিশনার কি রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল বা পুলিশ কমিশনারের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন?’’ এর সদুত্তর মেলেনি। প্রধান বিচারপতি হুঁশিয়ারি দেন, ‘‘বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না-নিলে পুর কমিশনারকে ফের আদালতে হাজির হতে হবে।’’
কাশীপুরে বেআইনি নির্মাণ নিয়ে এত টানাপড়েন কেন, কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে এ দিন তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। সবিস্তার ব্যাখ্যায় না-গিয়ে মেয়র শুধু বলেন, ‘‘হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে। আমরা গোটা বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখতে বলেছি।’’