২০১৪ সালের নভেম্বর।
একটি নতুন ওয়েবসাইটের উদ্বোধন হয়েছিল দুবরজপুর পুরসভার সভাকক্ষে। ওয়েবসাইটের উদ্বোধন কোনও নতুন বিষয় হয়তো নয়। কিন্তু, মফস্সল এলাকার এক যুবকের তৈরি করা ওই ওয়েবসাইট-ই চমকে দিয়েছিল এলাকার সৃজনশীল মানুষকে। ওই ওয়েবসাইটেই তিনি গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন গ্রামীণ লোকশিল্পীদের জন্য ডিজিটাল আর্কাইভ বা সংগ্রহশালা মাউসের একটি ক্লিকেই খুলে যাচ্ছে জেলার লোক সংস্কৃতির আয়না।
তিনি মহম্মদ ইনতাজ আলি। আদতে দুবরাজপুর শহরের ছেলে ইনতাজ বর্তমানে হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিষয়ের গবেষক। ইতিমধ্যেই জেলা, রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে পড়শি বাংলাদেশের লোকশিল্পীদের জায়গাও হয়েছে তাঁর তৈরি ওই ওয়েবসাইটে। গোটা বিষয়টিতে ইনতাজকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর শিক্ষক ও বন্ধুরা। ইনতাজ জানান, লোক কথা, কাহিনি ও বিশ্বাস নিয়েই তাঁর গবেষণার কাজ। সেই সূত্রে জেলার ও জেলার বাইরে বাউল, ফকির, পটুয়া, লোকনাটক আলকাপের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ এসেছে। অসংখ্য ঝুমুর, জারি, মুর্শিয়া গান সংগৃহীত হয়েছে। ‘‘শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় আর তথ্য সংগ্রহে আটকে থাকা বা গবেষণাপত্র জমা দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করতে চাইনি। মন চেয়েছিল ওঁদের জন্য কিছু করি। সেই ভাবনা থেকেই এই ওয়েবসাইট,’’—বলছেন ইনতাজ।
ঠিক কী রয়েছে এই সাইটে?
লোকসংস্কৃতির আর্কাইভ তৈরির পাশাপাশি বিশ্বের সঙ্গে গ্রাম-মফস্সলের লোকশিল্পীদের যোগাযোগ স্থাপনের উপায়টিকে আরও সহজ করে তুলেছে www.folkculturearchive.in নামে ওই ওয়েবসাইট। যার মাধ্যমে যে কেউ ওই সব শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিতে পারেন। তার জন্য সাইটে রয়েছে শিল্পীদের যোগাযোগের ঠিকানা ও ফোন নম্বর। ইনতাজ জানান, দিনের পর দিন পরিশ্রম করে তিনি ওই তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সাইটটিকে সমৃদ্ধি করতে লোকশিল্প ও সংস্কৃতির উপরে অডিও, ভিডিও এবং ফোটোগ্রাফের পাশাপাশি উক্ত বিষয়ে নানা লেখালেখি, গবেষণা, তথ্য, ইতিহাসও জুড়েছেন। এ ছাড়াও রয়েছে জেলার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানগুলির ইতিবৃত্ত।
দুবরাজপুরের ইসলামপুরে নিতান্ত ছাপোষা একটি পরিবারের ছেলে ইনতাজ। বাবা মনিরুদ্দিনের একটি ছোট্ট বিড়ি কারখানা রয়েছে। দুবরাজপুর সারদা বিদ্যাপীঠ স্কুলের পাঠ শেষ করে ইংরাজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে সিউড়ি কলজে যখন পড়ছেন, তখনও ঠিক কী করবেন স্পষ্ট ছিল না ইনতাজের কাছে। বাউল ও ফকিরি গানের ভক্ত ইনতাজ হায়দরাবাদের মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ন্যাশনাল উর্দু ইউনিভার্সিটিতে এমএ করার সময় থেকেই লোকসংস্কৃতির প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও বাড়তে থাকে। যার প্রাথমিক প্রকাশ ঘটে এমফিল করার সময়। হায়দরাবাদ ইউনিভার্সিটিতে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে এমফিল করেছেন বাউলগানের সমসাময়িক প্রেক্ষিত নিয়ে। এখানেই কোথাও ভবিষ্যতে চলার পথ ঠিক করে দিয়েছিল ইনতাজের। তাই ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শুরু করেছেন লোকসংস্কৃতি নিয়ে।
কোনও আর্থিক সাহায্য ছাড়া এমন একটি বিষয় নিয়ে তাঁর এই এগিয়ে চলাকে সম্মানের চোখে দেখছেন ইনতাজের বন্ধু আবু সালেখ। তিনি জানান, তুলনামূলক সাহিত্যের এই গবেষক নিজেকে শান দেওয়ার আর একটি সুযোগও ইতিমধ্যেই অর্জন করেছেন। আমেরিকার হাভার্ড ইউনিভার্সিটিতে একটি সাহিত্য বিষয়ক চার সপ্তাহব্যাপী আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন তিনি। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্য ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার্ল্ড লিটেরেচার’-এর ব্যবস্থাপনায় গত ২০ জুন থেকে সেই সেমিনার শুরুও হয়ে গিয়েছে। সারা বিশ্বের ৮০ জন আমন্ত্রিত গবেষকদের মধ্যে নিজের জায়গা হওয়ায় আপ্লুত ইনতাজ। তিনি বলছেন, “আমেরিকার এই কেন্দ্রটি তৈরিই হয়েছিল বিশ্বজুড়ে সাহিত্যচর্চার মধ্যে একটা সেতু বন্ধন করতে। সেখানে বিশ্ববন্দিত শিক্ষাবিদ, শিক্ষকদের কাছে শেখার এবং নিজেদের মধ্যে মত বিনিময়ের সুযোগ আমাকে গবেষণা চালাতে ও জীবনে চলার পথকে আরও সমৃদ্ধ করবে।’’