প্রশাসনিক স্তরে খাতায়কলমে বিরোধিতা না করলেও খাগড়াগড়ে কেন্দ্রীয় তদন্ত যে না-পসন্দ, সেটা বারে বারেই রাজনৈতিক ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিল শাসক দল। শুক্রবার এনআইএ খাগড়াগড়ের তদন্তভার আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রহণ করার দিন কিন্তু ফেসবুকে খোলাখুলিই নিজের ক্ষোভ উগরে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ দিনই দু’দফায় বিস্ফোরণস্থলে গেল বর্ধমান পুলিশ এবং সিআইডি-র দু’টি দল। ব্যাগবোঝাই করে নিয়ে গেল ‘অনেক নমুনা’।
বর্ধমান বিস্ফোরণের তদন্তভার তাদের দেওয়ার সিদ্ধান্তের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই এ দিন কাজ শুরু করে দিয়েছে জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ। সিআইডি-র সঙ্গে তাদের কথাবার্তাও হয়েছে। তদন্তে সাহায্য করার কথাও বলেছে রাজ্য পুলিশ-প্রশাসন। কিন্তু খোদ মুখ্যমন্ত্রীই যেখানে এনআইএ তদন্তের বিরোধী, সেখানে শাসক দল রাজ্য পুলিশকে সত্যিই কতটা সাহায্য করতে দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শেষ মুহূর্তে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টা চলছে, এমন অভিযোগও উঠছে।
শুক্রবার দুপুরে দিল্লিতে এনআইএ সদর দফতরে যখন এফআইএর দায়ের করার প্রস্তুতি চলছে, তখনই তদন্তকারীদের অন্য একটি দল কলকাতায় চলে আসে। বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের পাঁচটি ধারা, ভারতীয় দণ্ডবিধির আটটি ধারা এবং বিস্ফোরক আইনের দু’টি ধারায় এফআইআর করে কেন্দ্রীয় সংস্থাটি। পাশাপাশি নবান্নে এসে রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডির হাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশের প্রতিলিপি তুলে দেন এনআইএ-র প্রতিনিধিরা। একই সঙ্গে তাঁরা যে ওই তদন্তের দায়িত্ব নিচ্ছেন, সে কথাও লিখিত ভাবে ডিজিকে জানান।
এ দিনই ধৃতদের হেফাজতে নেওয়ার জন্য কলকাতার নগর দায়রা আদালতে আবেদন করেছে এনআইএ। ১৩ অক্টোবর এই আবেদনের শুনানি হবে। তবে তদন্তের স্বার্থে এনআইএ এখন থেকেই যে কোনও নথি বা সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করতে পারবে বলে জানিয়েছে আদালত।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, এনআইএ-র উত্তর-পূর্বাঞ্চল শাখা গোটা ঘটনাটির তদন্ত করবে। এসপি বিক্রম খালাটে-র নেতৃত্বে একটি দল ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়েছে। এ দিন ভবানী ভবনে সিআইডি কর্তাদের সঙ্গে দেখাও করে খালাটে-সহ পাঁচ জনের একটি দল। সিআইডি-র এডিজি রামফল পওয়ার এবং ডিআইজি (অপারেশন) দিলীপ আদকের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন তাঁরা। মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও সংগ্রহ করেন। সন্ধ্যায় ভবানী ভবন ছেড়ে যাওয়ার মুখে খালাটে বলেন, “আমরা ধাপে ধাপে তদন্ত শুরু করেছি। কেস ডায়েরি হাতে পেয়েছি। এ বার জেরা এবং ধরপাকড় শুরু হবে।”
তদন্তে গতি আনতে আজ, শনিবার দিল্লি থেকে কলকাতা আসছেন আইজি সঞ্জীব সিংহ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা জানাচ্ছেন, এনআইএ-র তরফে এ দেশে ইসলামি মৌলবাদ ও তজ্জনিত সন্ত্রাসের বিষয়টি নজরদারি করেন সঞ্জীবই। মালদহ ও মুর্শিদাবাদ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে জাল টাকা পাচারের তদন্তে গত দু’বছরে এ রাজ্যে একাধিক বার এসেছেন সঞ্জীব। পশ্চিমবঙ্গের ভূগোল সম্পর্কে কিছুটা পরিচিতি থাকায় তাঁকেই এই তদন্তের ‘কন্ট্রোলিং অফিসার’ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রকের এক মুখপাত্র। আগামী কাল, রবিবার এনআইএ-র যে দলটি খাগড়াগড়ে যাবে, তার নেতৃত্ব দেবেন সঞ্জীব।
ভবানী ভবনে দিল্লি পুলিশের বিশেষ দল।—নিজস্ব চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের রাজনৈতিক আপত্তি সত্ত্বেও খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তের ভার এনআইএ-র হাতে তুলে দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মন্ত্রক সূত্রে দাবি, তদন্তের শুরু থেকেই রাজ্য পুলিশের অদক্ষতা স্পষ্ট হয়েছিল। এই বিস্ফোরণের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি সীমান্তপারে মিত্ররাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। মন্ত্রকের মতে, এই তদন্তকে চূড়ান্ত অগ্রাধিকার দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না মোদী সরকারের কাছে।
যদিও এ নিয়ে এ দিন ফেসবুকে নিজের তীব্র অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিস্ফোরণের পর আট দিন কেটে গেলেও ঘটনাটি নিয়ে এ পর্যন্ত সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেননি তিনি। এ দিন ফেসবুকে তিনি লেখেন, “আজকাল দেখছি, কেন্দ্রীয় সরকার কথায় কথায় এবং অপ্রয়োজনীয় ভাবে রাজ্যের বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। এই ঘটনা অভূতপূর্ব, অগণতান্ত্রিক এবং নীতিহীন। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, রীতিনীতি ভেঙে ফেলার এই উদাহরণ ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত।”
মমতার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিজেপির জাতীয় সম্পাদক সিদ্ধার্থনাথ সিংহর মন্তব্য, “এনডিএ জমানায় বাজপেয়ী-আডবাণীর কাছে মমতাজি যখন প্রতিদিন বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ বা সিবিআই তদন্তের দাবি করতেন তখন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা তাঁর স্মরণে ছিল না! যেখানে দেশের সুরক্ষা বিপন্ন সেখানে এনআইএ-র মতো সংস্থাই তদন্ত করতে পারে। এখানে রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।” এনআইএ তদন্তকে স্বাগত জানান রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। তাঁর কথায়, ‘‘এনআইএ তদন্ত করছে। তদন্তের পরেই সব সত্য উঠে আসবে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্য। তাই বিশেষ সতর্কতা জরুরি।”
ঘটনা হল, সীমান্ত পারেও খাগড়াগড়ের ঘটনা যথেষ্ট উদ্বেগের সঞ্চার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে যে ভাবে বাংলাদেশে বিস্ফোরক পাচারের বিষয়টি উঠে আসতে শুরু করেছে, বিস্ফোরণে জড়িতদের সঙ্গে বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন (জেএমবি)-এর যে সম্ভাব্য যোগাযোগের খবর সামনে এসেছে, তাতে তৎপর হয়ে উঠেছে ঢাকা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে ভারতীয় দূতাবাসে। পাঠানো হয়েছে একটি নোটও। এনআইএ-কে তদন্তভার তুলে দেওয়ার এটাও অন্যতম কারণ বলে কেন্দ্রীয় সূত্রের খবর। কারণ, শেখ হাসিনা সরকারে আসার পর থেকে বাংলাদেশের মাটিতে ভারত-বিরোধী জঙ্গি ডেরাগুলি ধ্বংস করতে যে তৎপরতা দেখানো হয়েছে, তা দিল্লির কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। নরেন্দ্র মোদী চান না, হাসিনা সরকারের সঙ্গে সেই সম্পর্কে এতটুকুও চ্যুতি ঘটুক।
বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে গত কালই বিদেশ মন্ত্রকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা হয়। শুক্রবার বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন বলেন, “গোটা ঘটনাটি নিয়ে ভারতের সাহায্য চেয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নথিবদ্ধ করতে। প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হলেই আমরা তা বাংলাদেশি বন্ধুদের হাতে তুলে দেব।” এনআইএ সূত্রের খবর, জামাতুল মুজাহিদিনের এ-পারের নেটওয়ার্ক-এর পাশাপাশি রাজ্যে জামাতের চাঁইদের রাজনৈতিক যোগ নিয়েও তদন্ত করবে তারা।
তবে গোটা তদন্ত প্রক্রিয়ায় আগামী দিনে রাজ্যের কাছ থেকে কতটা সাহায্য পাওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা। সারদা তদন্তের অভিজ্ঞতা এই আশঙ্কা আরও বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে সারদার মতো এখানেও বিস্ফোরণ-কাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের আঁতাঁত রয়েছে বলে অভিযোগ। ফলে শাসক দলের নির্দেশে রাজ্য পুলিশ তথ্যপ্রমাণ লোপাট করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন মন্ত্রক কর্তারা।
সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্তে নেমে সিবিআই শাসক দলের এক সাংসদের মাধ্যমে বাংলাদেশে বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থায় টাকা পাঠানোর প্রমাণ পেয়েছে। এর মধ্যেই খাগড়াগড় বিস্ফোরণস্থলের নীচে তৃণমূলের পার্টি অফিস থাকার প্রমাণ মেলায় ফের শাসক দলের সঙ্গে মৌলবাদী যোগের অভিযোগ সামনে এসেছে। গত ২ অক্টোবর বিস্ফোরণের পর দিন বর্ধমানের পুলিশ সুপার এস এম এইচ মির্জা যে রিপোর্ট পাঠান, তাতে বাংলাদেশি মৌলবাদী সংস্থার যোগসাজশে এই বিস্ফোরণ হয়েছে বলে লেখা হয়েছিল। যদিও এই ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগের বিষয়ে কোনও কথা বলা হয়নি। কিন্তু ধৃতদের জেরা করে প্রাথমিক ভাবে সিআইডি যে তথ্য পেয়েছে, তাতে দক্ষিণ ও মধ্যবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে জামাতের মডিউল তৈরি হওয়ার সাক্ষ্য মিলেছে। তার পিছনে রাজনৈতিক প্রশ্রয় থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা। খাগড়াগড়ের ঘটনায় দিল্লি পুলিশও উদ্বিগ্ন। এ দিন দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের একটি দল কলকাতায় সিআইডি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ‘জঙ্গি মডিউল’ সম্পর্কে সিআইডি কর্তাদের কাছে বিশদ জানতে চান তাঁরা। ধৃত তিন জনকে জেরা করে কী মিলেছে, তার খুঁটিনাটিও জেনেছে ওই দলটি।