স্কুলের ইতিহাস বইতে পার্থ। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ
সিঙ্গুর আন্দোলন ঐতিহাসিক সাফল্য দিয়েছিল তৃণমূলকে। ক্ষমতায় আসার পরে সেই সিঙ্গুর আন্দোলনকে ইতিহাস বইতেও নিয়ে এসেছিল তৃণমূল। অষ্টম শ্রেণির পাঠ্য হিসাবে মধ্য শিক্ষা পর্ষদের ‘অতীত ও ঐতিহ্য’ বইতে উল্লেখ রয়েছে সেই আন্দোলন পর্বের কথা। আর সেখানেই উল্লেখ রয়েছে, ‘সেই আন্দোলনকে সুসংহত করে তার নেতৃত্ব দিলেন শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলনেতা পার্থ চ্যাটার্জী।’
এর পরে সেই তালিকায় সেই সময়ে আন্দোলনে বিশিষ্টজন হিসাবে যোগ দেওয়া বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর নাম রয়েছে। তৃণমূল নেতাদের মধ্যে শোভন চট্টোপাধ্যায়, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, মুকুল রায়দের নামও রয়েছে অষ্টম শ্রেণির ওই পাঠ্যপুস্তকে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর নামের পরের লাইনেই পার্থ। বাকিরা সেই অনুচ্ছেদের নীচের দিকে।
এখন পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হেফাজতে থাকা পার্থর সঙ্গে দূরত্ব বাড়াচ্ছে তৃণমূল। রবিবারও পার্থর মুখে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ শুনে পাল্টা আক্রমণ করেছে দল। এই রকম সময়ে তৃণমূলের ভিতরেও পার্থকে নিয়ে পুরনো অভিযোগ নতুন করে উঠেছে। এক নেতার কথায়, ‘‘তখন তিনি শিক্ষামন্ত্রী, তখন তিনি মহাসচিব। পাঠক্রমে সিঙ্গুর প্রসঙ্গ রাখার সিদ্ধান্ত দলগত হলেও নিজের নামটা নিজেই সবার উপরে নিয়ে এসেছিলেন। এখন সেই নামটাই দলের মুখ পোড়াচ্ছে। মুছে দেওয়া উচিত ওই নাম।’’
ওই তৃণমূল নেতা একা নন, অনেকেই নানা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত পার্থের নাম পাঠ্যপুস্তকের রাখার বিপক্ষে। তবে রাজ্য শিক্ষা দফতরের অধীনস্থ সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার বলেন, ‘‘এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। এটা নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত নেবেন বা নির্দেশে দেবেন তাই করা হবে।’’ একবার যখন ইতিহাস বইতে ঢোকানো হয়েছে সেটা বাদ দেওয়ার কোনও মানে হয় না বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তিনি বলেন, ‘‘আসলে তো এই নামগুলো ঢোকানোই উচিত হয়নি। বইতে নাম থাকা অনেকের বিরুদ্ধেই নানা অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এখন মুছে ফেলাটা হাস্যকর।’’ একই সঙ্গে পবিত্র বলেন, ‘‘তবে বিপুল আর্থিক কেলেঙ্কারি ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে এখন হারেম তৈরির অভিযোগ ওঠার পরে কোন মুখে শিক্ষকরা ওই নাম পড়াবেন ছাত্রছাত্রীদের?’’
এই সমস্যার কথা বলছেন শিক্ষকরাও। এক স্কুল শিক্ষকের বক্তব্য, ‘‘এর আগে এই তালিকায় থাকা অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। কাউকে কাউকে শাসক দলের পক্ষে ‘গদ্দার’ বলা হয়েছে। অনেকে দল বদলেছেন। অষ্টম শ্রেণির ছেলেমেয়েরা তো সে সব খবরও রাখে। ফলে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। তবে এ বার সমস্যা আরও প্রকট। কারণ, এ বার নারীঘটিত অভিযোগ সবার জানা। কোটি কোটি টাকার ছবি, মিম দেখে ফেলেছে ছাত্রছাত্রীরাও।’’
অষ্টম শ্রেণির সেই পাঠ্য বই।
অন্য দিকে, সিঙ্গুর আন্দোলন প্রসঙ্গে স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে কেন জায়গা পেয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গৌরব লামা। তিনি বলেন, ‘‘কোনও ঘটনা ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হতে গেলে তার জন্য একটা সময় দিতে হয়। এত কম সময়ের মধ্যে ইতিহাস হয়ে যেতে পারে না সিঙ্গুর আন্দোলন। আর যে বিষয় নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে তা স্কুল স্তরের পাঠ্যপুস্তকে মহিমান্বিত করা ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে নিজেরাই নিজেদের নাম ইতিহাস বইতে তুলেছেন। মাত্রাজ্ঞান না থাকার জন্যই এই সঙ্কট।’’
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে স্কুল শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন সিঙ্গুরের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। উচ্চশিক্ষা দফতর পান ব্রাত্য বসু। পরে ব্রাত্য একাই গোটা শিক্ষা দফতরের দায়িত্ব পান। কিন্তু সেটা কম সময়ের জন্য। তাঁকে সরিয়ে পার্থকে দেওয়া হয় শিক্ষা দফতর। ২০২১ সালে তৃতীয় তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এলে ব্রাত্য ফিরে পান শিক্ষা দফতর। তবে পাঠ্য পুস্তকে সিঙ্গুর আন্দোলনের অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত হয় ২০১৭ সালে। পার্থ তখন শিক্ষামন্ত্রী। পাঠক্রম চালু হয় ২০১৮ সালের শিক্ষাবর্ষ থেকে।