কারও মুখে হাসি ফোটেনি নবজাতকের আগমনে। কেউ উলু দেয়নি। বাজেনি শাঁখ। কী নাম রাখা হবে, তা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শুরু হয়নি তর্কাতর্কি, ছদ্ম মান-অভিমান, খুনসুটি। বরং জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই লেখা হয়ে গিয়েছিল তার মৃত্যুর নিদান। মাটি খুঁড়ে রাখা হয়েছিল বাড়ির পাশেই। সকলের অলক্ষে সেখানেই পুঁতে ফেলা হয়েছিল এক দিনের শিশুকন্যাটির দেহ। মাটির উপরে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল ঘাস। অভিযোগ, খুনের এমন ‘পরিপাটি’ চিত্রনাট্য লিখেছিল সদ্যোজাত ওই শিশুটির বাবা। তাতে মায়ের কী ভূমিকা ছিল, তা আপাতত খতিয়ে দেখছে পুলিশ। দু’জনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। ‘নারীজন্ম’ই ‘অপরাধ’ ছিল শিশুটির, প্রাথমিক তদন্তে এমনটাই জানতে পেরেছে পুলিশ।
শনিবার রাতে উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের কাঁঠালবেড়িয়া গ্রামের এই ঘটনার নৃশংসতায় শিউরে উঠছেন পোড় খাওয়া পুলিশ অফিসারেরাও। পাড়া-প্রতিবেশীরা হতবাক। বসিরহাটের এসডিপিও পিনাকী দত্ত বলেন, ‘‘মঙ্গলবার দুপুরে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুলিশ গিয়ে অভিযুক্ত রথীন মণ্ডলের বাড়ির বাগানের মাটি খুঁড়ে শিশুটির দেহটি উদ্ধার করে। এরপরেই গ্রেফতার করা হয় রথীন ও তার স্ত্রী অঙ্কিতাকে। দেহটি ময়না-তদন্তের জন্য বসিরহাট জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর দেড়েক আগে হিঙ্গলগঞ্জের কাঁঠালবেড়িয়া গ্রামের রথীনের সঙ্গে বিয়ে হয় পাশের পাড়ার বাসিন্দা অঙ্কিতার। রথীনের এই নিয়ে তিন নম্বর বিয়ে। বৃহস্পতিবার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ওই যুবক ভর্তি করেছিল দুলদুলির একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে। ওই দিনই শিশুকন্যা প্রসব করেন অঙ্কিতা।
তিন তিনটে বিয়ে হলেও এই প্রথম বার সন্তানের মুখ দেখেও হাসি ফোটেনি বাবার মুখে। আগের স্ত্রীরা নানা অশান্তির জেরে ছেড়ে গিয়েছিল ওই যুবককে। বিশেষ কাজকর্মও করে না সে। বাবা-মা থাকেন বেঙ্গালুরুতে। সেখান থেকে হাতখরচ পাঠান। তা দিয়েই সংসার চলে রথীনের।
এ হেন পরিবারে মেয়ে সন্তান জন্মানোয় খুশি না হওয়ার কোনও কারণ ছিল না রথীনের। কিন্তু খুশি তো হয়ইনি সে, উল্টে গোঁসা হয়। স্ত্রীকে পর দিনই নার্সিংহোম থেকে ছুটি করিয়ে বাড়িতে নিয়ে যায় সে।
তবে গাঁ-গঞ্জে এ সব ঘটনায় দশ জন ভিড় করে আসেই। রথীনের বাড়িতেও জড়ো হয়েছিলেন পাড়ার মেয়ে-বউরা। কিন্তু এ কথা সে কথা বলে শিশুটিকে দেখাতে রাজি হয়নি মণ্ডল দম্পতি। তাতে কৌতুহল আরও বাড়ে। শনিবার অনেকেই জড়ো হন রথীনের বাড়িতে। ‘‘কই গো, বাচ্চা কই, মুখখানা দেখি এক বার...কার মতো দেখতে হল গো? বাপের আদল পেল না মায়ের...’’ পড়শিদের টুকরো টুকরো প্রশ্নের উত্তরে কোনও সদুত্তর ছিল না দম্পতির মুখে। এটা সময়ে তারা বলে, জন্মের পর থেকেই নিখোঁজ শিশু। তা-ই বা বিশ্বাস হবে কী করে! কারণ নানা সময়ে নানা রকম কিছু শোনা যাচ্ছে যে রথীন-অঙ্কিতার মুখে। শেষমেশ, রথীনের এক নিকট আত্মীয় অনুপ মণ্ডল বিষয়টি জানান পুলিশকে। সে কথা লোক মারফত কানে আসায় গ্রাম ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করে ওই দম্পত্তি। সোমবার ভোরে যোগেশগঞ্জের সর্দারপাড়া ফেরিঘাট থেকে নৌকায় ওঠার সময়ে খবর পেয়ে হিঙ্গলগঞ্জ থানার পুলিশ তাদের আটক করে।
পুলিশের দাবি, জেরার মুখে একটা সময়ে ভেঙে পড়ে রথীন। অপরাধ শিকার করে জানায়, গলা টিপে খুন করে বাড়ির বাগানে পুঁতে দিয়েছে মেয়েকে। মঙ্গলবার হিঙ্গলগঞ্জের বিডিও সুদীপ্ত মণ্ডলের উপস্থিতেতে ওই জায়গা থেকেই টাটকা পোঁতা ঘাস সরিয়ে, মাটি খুঁড়ে মেলে শিশুর দেহ। এরপরে ওই দম্পতিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। রথীনের এক খুড়তুতো ভাই অনুপবাবু বলেন, ‘‘পাশের পাড়ার মেয়ে অঙ্কিতাকে ভালবেসেই বিয়ে করেছিল রথীন। কাকা-কাকিমার মেয়ে হয়েছে শুনে গিয়ে দেখি শিশু নেই। জিজ্ঞাসা করলে বলে, রাতের দিকে কেউ বাচ্চাটাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বন্ধ ঘর থেকে কী ভাবে শিশু চুরি হল, তা ওরা বোঝাতে পারেনি। তাতেই সন্দেহ বাড়ে।’’ অনুপবাবু জানিয়েছেন, খোঁজ-খবরের সময়ে কাকার বাগানের এক কোণে চোখে পড়ে, সদ্য মাটি খোঁড়া হয়েছে। ঘাসও পোঁতা সেখানে। পুলিশের দ্বারস্থ হন তিনি।
কী বলছেন অঙ্কিতা?
পুলিশ কর্তাদের দাবি, সারাক্ষণ থম মেরে বসে তরুণী। মুখে রা কাড়ছেন না। অল্পকথায় এক বারই নাকি জানিয়েছেন যে, মেয়ে হোক, চায়নি স্বামী। তার কোল থেকে কেড়ে মেয়েকে খুন করেছে রথীনই। কিন্তু তিনি কেন পড়শিদের জানাননি সে কথা? আর উত্তর নেই অঙ্কিতার মুখে।