শান্তিনিকেতনে সোনাঝুরি শালবন থেকে হয় মাটি চুরি সোমবার। ছবিঃ বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
ঐতিহ্যক্ষেত্রের আওতায় যদিও নেই, কিন্তু খোয়াইয়ের প্রকৃতি আর কোপাই নামের ছোট নদী ছাড়া কি শান্তিনিকেতন পূর্ণ হয়? ইউনেস্কোর সম্মান প্রাপ্তির সময়ে এই দুই জায়গা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন স্থানীয় এবং শান্তিনিকেতনবাসীদের একাংশ। তাঁদের জিজ্ঞাসা, কোথায় কোপাইয়ের স্ফটিকজল? খোয়াইও কি হারিয়ে যাচ্ছে না? প্রশাসন অবশ্য দাবি করেছে, সম্পদ নষ্টের খোঁজ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বীরভূমে কোপাইয়ের অনেক রূপ। লাভপুরে হাঁসুলি বাঁক, কঙ্কালীতলার শ্মশানের পিছন দিয়েও তির তির করে বয়ে গিয়েছে এই নদী। তবে ছোট নদীর যে চিত্ররূপ তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তা যেন অনেক বেশি দেখা যায় শান্তিনিকেতনের কাছে এসে। সেখানে সে কবির বর্ণনায় ‘প্রতিবেশিনী কোপাই নদী’। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘রাস্তা যেখানে থেমেছে তীরে এসে/ সেখানে ও পথিককে দেয় পথ ছেড়ে/ কলকল স্ফটিকস্বচ্ছ স্রোতের উপর দিয়ে...’।
কিন্তু কোথায় সেই স্ফটিকজল? বছরের বেশির ভাগ সময়ে পায়ের পাতা ডোবে না কোপাইয়ে। নদীটি এখন মজে যাওয়ার পথে। যথেচ্ছ কংক্রিটের নির্মাণ আর ইটভাটার দাপটে হারিয়ে গিয়েছে নদীর তীরবর্তী পরিবেশ। খোয়াইয়ের তো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই ভার। এই দু’টিই যে-ভাবে ধ্বংস হচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নদীবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে পরিবেশবিদেরা। তাঁরা মনে করছেন, এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া গেলে কোপাই আর খোয়াই মানচিত্র থেকেই মুছে যেতে পারে। কিন্তু, খোয়াই-কোপাইকে বাঁচাতে কবে প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
স্থানীয়দের অনেকেই জানাচ্ছেন, আশির দশকের শেষ দিক থেকেই এই দু’টির ধ্বংস শুরু হয়েছিল। যা ক্রমে ব্যাপক আকার নিয়েছে। কোপাইয়ের উৎস ঝাড়খণ্ডের খাজুড়িতে। সেখান থেকে দুবরাজপুর, খয়রাশোল, ইলামবাজার, লাভপুর এলাকা দিয়ে বয়ে চলেছে। উৎস থেকে প্রবাহিত হওয়ার পরেই নদীর পরিচিতি ‘শাল’ নামে। বোলপুরের বিনুরিয়া গ্রামের কাছে নদীর নাম বদলে হয়েছে কোপাই। একটা সময়ে নদী তীরবর্তী মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল এই নদীর। ২০১৭ সালে কোপাইয়ের উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার পথ হেঁটেছিলেন নদী-গবেষক তথা বিশ্বভারতীর প্রাক্তন অধ্যাপক মলয় মুখোপাধ্যায়। তিনি তখনই জানিয়েছিলেন, নদীর পাড়ে ইটভাটা তৈরি করা এবং বেআইনি ভাবে বালি তোলার ফলে কোপাইয়ের বিপদ বাড়ছে। কার্যক্ষেত্রে সেটাই দেখা যাচ্ছে, বলেছেন স্থানীয় মানুষও।
কী ভাবে? প্রশাসন সূত্রেই জানা যাচ্ছে, বর্তমানে এই নদীর ধারে বিভিন্ন জায়গায় ২৮টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। নদীর চর দখল করে তোলা হচ্ছে পাঁচিল। মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “গত কয়েক বছরে যে-ভাবে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চলেছে কোপাই ও খোয়াইয়ের উপরে, তাতে তারা তাদের গরিমা হারিয়েছে। তবে আশা রাখছি, এই হেরিটেজ ঘোষণার পরে এলাকার মানুষের আত্মমর্যাদা বাড়বে। হয়তো এই দু’টিকে সংরক্ষণের প্রচেষ্টাও জোর পাবে।’’
বাম আমলে অভিযোগ উঠেছিল প্রান্তিক লাগোয়া খোয়াই এলাকা ধ্বংস করে নির্মাণকাজ চালানোর। যা নিয়ে সেই সময় একাধিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। ‘শান্তিনিকেতন খোয়াই বাঁচাও আন্দোলন’-এর অন্যতম মুখ ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। অভিযোগ, গত কয়েক বছরে খোয়াইকে ধ্বংস করে অসংখ্য বসতি যেমন গড়ে উঠেছে, তেমনই নির্বিচারে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। খোয়াই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা আহসান কামালের কথায়, “খোয়াই ও কোপাইয়ের সৌন্দর্য দেখেই রবীন্দ্রনাথ এখানে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার ভাবনা শুরু করেছিলেন। কারণ, এখানে প্রকৃতি আছে। কিন্তু আজ শান্তিনিকেতন হেরিটেজ ঘোষণা হলেও মূল অংশ বাদ থেকে যাওয়ায় কোপাই-খোয়াই বঞ্চিত থেকে গেল।” প্রকৃতিপ্রেমী ঊর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এই দুই নদী ধ্বংস হচ্ছে মানুষের অসচেতনতার জন্য। এই দু’টি জায়গা রবীন্দ্রনাথের বহু রচনায় স্থান পেয়েছে। তাই প্রশাসন এবং সর্ব সাধারণের উচিত তাদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা।”
এই বিষয়ে মহকুমাশাসক (বোলপুর) অয়ন নাথ বলেন, ‘‘খোয়াই ও কোপাই নদী সংলগ্ন এলাকায় যাতে অরণ্য ধ্বংস না হয়, তার জন্য বন দফতর থেকে শুরু করে বোলপুর পুরসভা নজরদারি চালাচ্ছে। একটি কমিটিও গড়া হয়েছে, যারা এই সমস্ত সম্পদকে রক্ষা করতে সদা তৎপর। সম্পদ নষ্টের বা দখলের কোনও অভিযোগ পেলেই আমরা আইনত ব্যবস্থা নেব।’’