কলকাতা হাই কোর্ট। ফাইল ছবি।
নারদ মামলা অন্যত্র স্থানান্তর বিষয়ক শুনানি মঙ্গলবারের মতো শেষ হল। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় ফের এই মামলার শুনানি হবে।
মেহতার যুক্তি শুনে বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মেহতা বেশ উজ্জ্বল যুক্তি দিয়েছেন আপনি। আপনার যুক্তি শুনে নিজেকে ছাত্র বলে মনে হচ্ছিল।’’
কল্যাণকে থামিয়ে দেওয়ার পর মেহতা বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘‘স্বয়ং আইনমন্ত্রী হাজার মানুষের সঙ্গে আদালতের বাইরে বিক্ষোভ দেখালেন। বিচারক প্রভাবিত না হলেও সাধারণ মানুষের মনে হতে পারে এই জামিন বাধ্য হয়ে দেওয়া।’’
এর জবাবে বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন বলেন, ‘‘সেদিনের সওয়াল নিরপেক্ষ বলে মনে হচ্ছিল না, তাহলে শুনানি থামিয়ে দিতে পারতেন।’’
উত্তরে মেহতা বলেন, ‘‘আমি বলছি আদালত শুধু জামিন নিয়ে শুনেছে। বাকিটা মামলার তো শুনানিই হয়নি।’’ এর পর মেহতার সংযোজন, ‘‘ভেবে দেখুন বিশেষ আদালতে মন্ত্রীরা গিয়েছিলেন শুধুমাত্র জামিন করানোর জন্য। আমি বার বার বলছি এই ধরনের পরিকল্পিত গুন্ডামি পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে। এটা প্রথম নয়। এর আগে যখন পুলিশ কমিশনারকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করেছিল তখনও এমন ঘটেছিল। যখন ক্ষমতাসীন কেউ গ্রেফতার হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী তার প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমে পড়েছেন।’’
বিচারপতি এবং কেন্দ্রের সলিসেটর জেনারেলের মধ্যে কথা হওয়ার সময়ই অভিযুক্তদের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলে ওঠেন, ‘‘কেউ ভিতরে যাননি। এজলাসেও কেউ ছিল না।’’
তখন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বিন্দল বলেন, ‘‘আপনাকে যখন সময় দেওয়া হবে তখন বলবেন। মাঝে বলবেন না।’’
বিচারপতি সৌমেন সেন বলেন, ‘‘সে দিন ভার্চুয়াল শুনানি হয়েছে। আইনমন্ত্রী এবং বাকিরা আদালতের বাইরে বিক্ষোভ করছেন, এতে সমস্যা কোথায়? চার্জশিট জমা হয়েছে ভার্চুয়ালি। আপনার কথার যৌক্তিকতা কোথায়?’’
জবাবে মেহতা বলেন, ‘‘পাবলিক ইন লার্জের কথা বলা হচ্ছে।’’
পক্ষপাতের বিষয়টি নিয়ে মেহতার ব্যাখ্যা শোনার পর বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় মেহতা জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আমাদের সংবিধানে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ দেখানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটা কী ভাবে বিচার প্রক্রিয়ার উপর প্রভাব ফেলেছে সেটা বলুন।’’
মেহতা বলেন, ‘‘বিচারকের মনোভাব পক্ষপাতদুষ্ট নাও হতে পারে। কিন্তু বাইরে যে ভাবে ভয় দেখানো হয়েছে। তার জন্য পক্ষপাতের বিষয়টি আমি বলেছি।’’
পক্ষপাতিত্ব এবং নিরপেক্ষতার প্রশ্নে পিনোশেতের উদাহরণ টানলেন কেন্দ্রের সলিসেটর জেনারেল তুষার মেহতা। তিনি বলেন, ‘‘পিনোশেতের রায়ে বলা হয়েছে, কোনও রায়ের ক্ষেত্রে তৃতীয় নীতি হল, ওই রায়ের পক্ষে সাধারণ মানুষের ধারণা কি?’’ প্রসঙ্গত পিনোশেত ছিলেন চিলির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। স্বৈরাচারি হিসাবে পরিচিত ছিলেন তিনি।
নিরপেক্ষতার বিষয়টি নিয়ে মেহতা সাফাই, ‘‘আমি বিচারপতিদের দিক থেকে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলছি না। আমি বলতে চাইছি, বাইরের পরিস্থিতির কারণে বিচারপতি নিরপেক্ষ নাও হতে পারেন। তাই এটা সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা উচিত।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বহু উদাহরণ দেখা যায় যেখানে সাধারণ মানুষ বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ করেন। এই অবস্থায় কি কোনও বিচারপতি নিজেকে নিরপেক্ষ রাখতে পারেন? সাধারণ মানুষের উপরও তো এর প্রভাব পড়ে।’’
বিচারপতিদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মন্তব্য করেছেন মেহতা। তা শুনেই গর্জে উঠলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দল। মেহতার উদ্দেশে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আপনি কি বিচারের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে কথা বলতে চান?’’
শুনানি শুরু হতেই বলতে শুরু করলেন কেন্দ্রের সলিসেটর জেনারেল তুষার মেহতা। বিচারপতিদের উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, ‘‘বিচার বলে বিচারপতিকে শুধু নিরপেক্ষ হলেই হবে না, তাঁকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতেও দেখতে হবে।’’
আপাতত বিরতি হল নারদ মামলার স্থানান্তরের শুনানিতে। দুপুর ২টোয় ফের শুনানি শুরু হবে বলে জানিয়েছেন বিচারপতিরা।
সিবিআইয়ের আইনজীবী মেহতা বলেন, ‘‘কেন্দ্র এবং রাজ্যের অনেক মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু এ রকম গুন্ডাগিরি কোথাও দেখা যায়নি।’’
মেহতা: আমি শুধু বলতে চাইছি এখানে এ রকম ঘটনা প্রায়ই হয়। ওই দিনের ঘটনা পরিকল্পিত ছিল কি না তা নিয়ে আমি কিছু বলছি না। আমরা রাজনৈতিক গ্রেফতার দেখেছি। কিন্তু এ রাজ্যের মতো ঘটনা কোথাও হয়নি। পৃথিবীর কোনও গনতান্ত্রিক দেশে এ রকম হয়েছে কি না সন্দেহ।এখানে দু’টো বিষয়কে দেখা হোক। প্রথমত, একটা তদন্তকারী সংস্থা সুষ্ঠভাবে তদন্ত করতে পারেনি। এটা কি ঠিক হয়েছে?
দ্বিতীয়ত, একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টি থেকে দেখলে, এই মামলায় বিচার পাওয়া উচিত। এ বার সেটা যদি ন্যায় বিচার না হয় তাহলে কি করে হবে?
বিচারপতি অরিজিৎ মুখোপাধ্যায়: যে ঘটনা বলছেন সেখানে কি গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্ত জামিনের আর্জি করেছিলেন?
বিচারপতি সৌমেন সেন: এই ঘটনাগুলোয় কাজে বাধা দেওয়ার জন্য সিবিআই কি কারও বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছিল? একজন অভিযুক্তকে যখন আইনি রক্ষাকবচ দেওয়া হচ্ছে, তখন আপনার করা অভিযোগগুলোর কী সম্পর্ক?
বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়: সাধারণ মানুষের উপর গোটা ঘটনা প্রভাব ফেলবে। কিন্তু এই অভিযুক্তরা যদি জড়িত না থাকেন তাহলে কেন তাঁরা ভুক্তভোগী হবেন?
তুষার: এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা বারবার হয়। তদন্ত সংস্থা কোনও বড় রাজনৈতিক বিষয়ে জড়িত থাকলেই এ রকম হয়। আগেও হয়েছে। ২০১৪ সালে এই ঘটনা হয়েছে। গ্রেফতার করা মাত্রই সাংবাদিক বৈঠক হয়েছে। তার পরের দিনই বিক্ষোভ হয়েছে। হুমকিও দেওয়া হয়েছে। এই সব কিছু রাজ্য সরকারের সমর্থনে হয়েছে। এতে শুধু অফিসারদের নিরাপত্তা নয়, বিচারব্যবস্থার উপরেও হুমকি।
এর পরই ২০১৪ সালের প্রসঙ্গে মেহতা বলেনস ‘‘সল্টলেকে সিবিআই অফিসারকে আটকে রাখা হয়। এক জন গ্রেফতার হওয়ার পর ধর্নাও দেওয়া হয়। সল্টলেক সিজিও কমপ্লেক্সে প্রচুর লোক স্লোগান তোলেন। লোকাল বিধায়করা হুমকিও দিয়েছিল।’’
মেহতা: সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি কিন্তু এই প্রথম নয়। এবং বিচ্ছিন্ন নয়। ওজনদার নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হলেই পশ্চিমবঙ্গে এ রকম পরিবেশ তৈরি করা হয়। এটাকে ‘টেমপ্লেট আচরণ’ বলা যায়।
এর পর মেহতা বলেন, ‘‘আমি আপনাদের কাছে জানতে চাইছি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই কোনও তদন্ত করলে সেটার বিচার প্রক্রিয়া কী হওয়া উচিত। এই বিষয়টি আদালতের নজরে আনা উচিত।’’
চার্জশিটের প্রসঙ্গে মেহতা বলেন, ‘‘সিবিআই অফিসারদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল। তাই তাঁরা ওই দিন সন্ধ্যায় সশরীরে জমা দিয়ে আসে।’’ মেহতা আরও বলেন, ‘‘ওই দিন সিবিআই অফিস এবং আদালতের বাইরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তা শুধু তদন্তকারী সংস্থাকে প্রভাবিত করেনি। বরং বিচার প্রক্রিয়ার উপরও প্রভাব ফেলেছিল।’’ মেহতা বলেন, ‘‘ওই দিন দু’জায়গায় ঘটা ঘটনার কিছু ছবি আমি দেখাতে চাই।’’ তা দেখিয়ে মেহতা বলেন, ‘‘আমি যদি বলি গ্রেফতার বেআইনি ছিল। তার পরও কি জনপ্রতিনিধি, যাঁরা মানুষের সামনে ভাল উদাহরণ তৈরি করেন, তাঁরা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন?’’
‘‘ওই দিন চার্জশিট কি ভার্চুয়ালি জমা দিয়েছিলেন বিশেষ আদালতে?’’, মেহতা প্রশ্ন বিচারপতি সৌমেন সেনের।
জবাবে মেহতা বলেন, ‘‘সিবিআই অফিসারদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল। তাই তাঁরা ওই দিন সন্ধ্যায় সশরীরে জমা দিয়ে আসে।’’ মেহতা আরও বলেন, ‘‘ওই দিন সিবিআই অফিস এবং আদালতের বাইরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তা শুধু তদন্তকারী সংস্থাকে প্রভাবিত করেনি। বরং বিচার প্রক্রিয়ার উপরও প্রভাব ফেলেছিল।’’
মেহতার প্রতি বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আপনি বলুন অভিযুক্তদের ঠিক কখন, কোথা থেকে, কোন পরিস্থিতিতে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ঘটনার হুবহু বর্ণনা দিন। এটা আমাদের জানা জরুরি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’