৬০০ মেগাওয়াটের সপ্তম ইউনিট তৈরির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে সার্ভের জন্য সবুজ সঙ্কেত মেলায় উচ্ছ্বসিত শিল্পনগরী ফরাক্কা।
সম্প্রতি ফরাক্কায় কর্মীদের সঙ্গে এক বৈঠকে ওই সার্ভে করার কথা ঘোষণা করেন এনটিপিসির চেয়ারম্যান অরূপ রায়চৌধুরী। চেয়ারম্যানের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে ডান বাম সব রাজনৈতিক দলই। ফরাক্কায় এনটিপিসির নিজস্ব জমি রয়েছে। ঝাড়খণ্ডের পাশাপাশি জলপথে কয়লা আসায় কয়লা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। গঙ্গার ফিডার ক্যানাল থাকায় সমস্যা নেই জলেরও। তাই ফরাক্কায় নতুন একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়া হলে কোনও অসুবিধা হবে না বলে মনে করছেন ওই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্তা-কর্মীরা। তবে সে সবের জোগান কতটা পরিমাণে মিলবে তা খতিয়ে দেখতে দ্রুত সমীক্ষার কাজ শুরু করা হবে। এ নিয়ে ফরাক্কার স্থানীয় বিধায়ক মইনুল হকের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি। এর ফলে গুরুত্ব হারানো শিল্পশহর ফরাক্কায় স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ যেমন বাড়বে, তেমনই পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে শিল্প সম্ভাবনার বাতাবরণও তৈরি হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দা থেকে বিশেষজ্ঞরা। ফরাক্কায় বর্তমানে ৪৫০৬ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ৬টি ইউনিট। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২১০০ মেগাওয়াট। বছরে কয়লা লাগে ১০.৬ মিলিয়ন টন। ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে জলপথে কয়লা আনার ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। দেশের মধ্যে একমাত্র ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেই সুবিধা রয়েছে। এনটিপিসির এক পদস্থ কর্তা জানান, কাটোয়ায় ১৩২০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে জমি ও কয়লা নিয়ে বিস্তর সমস্যা পোহাতে হচ্ছে এনটিপিসিকে। সে জন্য মাস ছয়েকের জন্য প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে দিতে হয়েছে। ফরাক্কায় সে সব সমস্যা নেই। প্ল্যান্টের ভিতরেই প্রচুর অব্যবহৃত জমি পড়ে রয়েছে। পরিকল্পিত ভাবে যদি সেই জমি ব্যবহার করা যায় সেখানে আরও একটি ৬০০ মেগাওয়াটের ইউনিট গড়ার সুযোগ রয়েছে। ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মুখ্য জনসংযোগ অধিকর্তা শৈবাল ঘোষ বলেন, “এ মাসের প্রথম সপ্তাহে চেয়ারম্যান নিজে ফরাক্কায় এনটিপিসির কর্মীদের নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। প্ল্যান্টের অগ্রগতি, সম্ভাবনা ইত্যাদি খতিয়ে দেখতে কর্মীদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে ওই বৈঠকে। সেখানে আরও একটি বড় তাপবিদ্যুৎ ইউনিট গড়ার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। জমি, জল ও কয়লা যেহেতু এই তিনটি ক্ষেত্রে ফরাক্কা অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। তাই সপ্তম ইউনিট গড়ার ইঙ্গিত দিয়ে তা নিয়ে সমীক্ষা শুরুর কথা বলা হয়েছে।”
বর্তমানে ফরাক্কায় এনটিপিসির কর্মীদের থাকার জন্য ৩টি টাউনশিপ রয়েছে। তার মধ্যে নবারুণের অস্থায়ী টাউনশিপকে গুটিয়ে ফেলার চিন্তাভাবনা করছে এনটিপিসি। সেইসঙ্গে ফিল্ড হোস্টেল টাউনশিপকে নতুন ভাবে সাজানোর কাজ শুরু হয়েছে। কর্তাদের কথায়, নবারুণের বিপুল পরিমাণ জমিকে কাজে লাগিয়ে তাপবিদ্যুতের সপ্তম ইউনিট ও একটি সোলার ইউনিট গড়া যেতে পারে। সব দিক খতিয়ে দেখেই ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রসার ঘটানোর চিন্তা চলছে।
ওই পদস্থ কর্তার কথায়, “আগে এনটিপিসিতে পূর্বাঞ্চলের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি সে ভাবে গুরুত্ব পেত না। এখন তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে ফরাক্কা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেই একটি করে সোলার ইউনিট গড়া বাধ্যতামুলক করতে চলেছে। সে ক্ষেত্রেও ফরাক্কাতে একটি বড় মাপের সোলার ইউনিট তৈরি করতে হলে সেই জমিও ফরাক্কায় রয়েছে।”
শৈবালবাবু। তিনি জানান, ফরাক্কাতে ৬টি ইউনিট চলছে। বছরে প্রায় ৪১ লক্ষ মেট্রিক টন ছাই তৈরি হয়। অ্যাসবেস্টস, ইট ও সিমেন্ট তৈরির কাজে ৯০ শতাংশের উপর ছাই ব্যবহার করা সম্ভব হয়। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ফোর লেন নির্মাণেও ছাই ব্যবহার করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও অবিলম্বে আরও অ্যাস পন্ড নির্মাণ করা দরকার। স্থানীয় গ্রামবাসী, প্রশাসনিক কর্তা ও রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের নিয়ে বহু বার বৈঠক করেও সমস্যার সমাধান হয়নি। স্থানীয় গ্রামবাসীদের বাধায় অ্যাস পন্ড নির্মাণ করা যাচ্ছে না। সেই জন্যই পরবর্তীতে ফরাক্কায় কোনও ইউনিট তৈরি করতে গেলে অ্যাস পন্ড তৈরির কথাটা মাথায় রেখে স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্য দরকার।”
ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কর্মী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ মিশ্র বলেন, ‘‘ফরাক্কায় আরও একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়লে যে কোনও সমস্যা হবে না তা এ দিনের ওই আলোচনায় চেয়ারম্যানকে বোঝানো গিয়েছে। এ ব্যাপারে তাঁর আশ্বাস পেয়ে কর্মীরা সকলেই খুশি।”
স্থানীয় বিধায়ক মইনুল হক বলেন, “ফরাক্কায় এনটিপিসি ৬০০ মেগাওয়াটের আরও একটি তাপবিদ্যুৎ ইউনিট গড়তে চাইছে। নতুন ইউনিট হলে স্থানীয় এলাকায় কর্ম সংস্থানের সুযোগ বাড়বে। তাই এনটিপিসির চেয়ারম্যানকে আমরা সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছি।” তিনি জানান, ২০১৫ সালের মধ্যেই এ নিয়ে সমীক্ষার কাজ দ্রুত শেষ করে ফেলা হবে। এমনকী চেয়ারম্যান ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে ফরাক্কার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ৮০ নম্বর জাতীয় সড়কের এনটিপিসি থেকে বেওয়া পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার বেহাল রাস্তা তৈরির জন্য টেন্ডার ডাকার কথাও জানিয়েছেন।”
সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আবুল হাসনাত খান বলেন, “ফরাক্কা ব্যারাজ তৈরির পর ব্যারাজের কর্মীর সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় বহু মানুষ এই শিল্পশহর ছেড়ে চলে গিয়েছেন। সপ্তম ইউনিট তৈরি হলে রাজ্যে বিদ্যুতের জোগান বাড়বে। বহু স্থানীয় মানুষ কাজ পাবেন।”
তৃণমুলের জেলা কমিটির সহ-সভাপতি সোমেন পাণ্ডে বলেন, “ফরাক্কায় শিল্প পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনও সমস্যা কখনও হয়নি। এনটিপিসির এই ঘোষণাকে স্বাগত। পিছিয়ে পড়া মালদহ ও মুর্শিদাবাদে শিল্প সম্ভাবনা তৈরি হবে।”