শৌচাগার গড়ছেন ময়না, রহিমারা

Advertisement

পারমিতা মুখোপাধ্যায়

মুর্শিদাবাদ শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ২০:২৭
Share:

হাফিজুল শেখ ও হবিবুল্লা শেখ, কেরলে মিস্ত্রির কাজ করেন। গত বছর বাড়ি ফিরে শুনলেন তাঁদের মা-ও মিস্ত্রির কাজ করতে চলেছেন, তখন খানিকটা অবাকই হয়েছিলেন। পরে নিজেদের যন্ত্রপাতি কিছু কিছু রেখে যান বাড়িতে, মায়ের জন্য।

Advertisement

সেই সব যন্ত্রপাতি এখন যত্ন করে রাখেন রাহিমা বিবি। সকাল থেকে শুরু হয় কাজ। সবার শৌচাগার প্রকল্পের আওতায় শৌচাগারের জন্য পিট বা পিটের ঢাকনা তৈরি করেন। ৮টা-৫টার কাজে রোজগার হয় বেশ ভালই—হাতের কাজ সামলে নিতে নিতে বলছিলেন তিনি। নবদ্বীপ ব্লকে মহীশুড়ার বাসিন্দা রাহিমাবিবি বহু দিন ধরেই স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে কাজ করছেন। কিন্তু গত দেড় বছরে ‘সবার শৌচাগার’ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর আয় বেড়েছে বেশ খানিকটা।

আর সব থেকে মজার কথা হল জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে তিনি পেয়েছেন একটা নতুন পরিচয়। “এত দিন সবাই জানত শুধু পুরুষ মানুষই মিস্ত্রির কাজ করে। মেয়েরা শুধু তাঁদের জোগাড়ে। কিন্তু আমাদের তো ট্রেনিং দিয়ে মিস্ত্রি বানিয়ে দিল। আমরা নিজেরাই এখন নির্মাণ করতে পারি”—বললেন তিনি।

Advertisement

নদিয়া জেলায় সবার শৌচাগার প্রকল্প স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নির্মাণের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন মহিলাদের মর্যাদা রক্ষায় নয়া দিক নির্দেশ করছে, তমনই মহিলাদের রোজগারের পথ গড়ে দিয়ে আর এক দিকে মর্যাদার ভিত্তি মজবুত করছে। অন্তত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের দেখলে তেমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। জেলাশাসক পিবি সেলিম নিজেই জানিয়েছিলেন ইচ্ছা করেই এই প্রকল্পে নেওয়া হয়েছে মহিলাদের। যাতে রোজগার বৃদ্ধির পাশাপাশি তাঁরা নিজেরাও যুক্ত হয়ে যেতে পারেন প্রকল্পের সঙ্গে। নিজে হাতে শৌচাগার তৈরি করতে শিখলে, গড়ে উঠবে সচেতনতা।

আর তেমনটাই যে হয়েছে তা জানালেন মহিলারাই। মহীশুড়াতেই দেখা হয়ে গেল ঝুম্পা বিবির সঙ্গে। বছর তেইশের গৃহবধূ। বাপের বাড়ি মন্তেশ্বর থানা এলাকায়। সেখানে কোনও দিন শৌচাগার ছিল না। বাইরে যাওয়াই ছিল অভ্যাস। এতদিন শ্বশুরবাড়িতেও তেমনই ছিল নিয়ম। শাশুড়ির কাজের দৌলতে তাঁদের বাড়িতে তৈরি হয়েছে শৌচাগার। পড়ন্ত বিকেলে ঘরের কাজ করতে করতেই ঝুম্পা বলেন, “আগে কত অসুবিধা হত। সকাল, সন্ধ্যা ছাড়া শৌচে যাওয়া যেত না। শরীর খারাপ লাগত। এখন সে সব নেই।”

নিজেদের রোজগার নিয়েও খুশি ময়না, মুনমুন, পারভিনা বিবির মতো মহিলারা। মহীশুড়া গ্রামের সোনা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করেন পারভিনা বিবি। তিনি জানান, “আগে হাঁসমুরগি পালনে যে টাকা পেতাম, এখন তার থেকে অনেক বেশি টাকা রোজগার করতে পারছি। আমরা বাড়িতে শৌচাগারটাও বানিয়ে নিতে পেরেছি।” কিন্তু ঠিক কেমন এই রোজগারের বিষয়টি? চার পাঁচটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যাদের নিয়ে তৈরি হয় ক্লাস্টার কমিটি। তেমনই হাঁসখালি দক্ষিণপাড়া ক্লাস্টার কমিটি সদস্যা শিখা ঘোষ জানালেন, সবার শৌচাগার প্রকল্পে ৯০০ টাকা নেওয়া হয় উপভোক্তার কাছ থেকে। বাকি ১০ হাজার টাকা দেয় সরকার। গ্রামে গ্রামে গিয়ে উপভোক্তাদের থেকে টাকা সংগ্রহ করা থেকে, শৌচাগারের সামগ্রি নির্মাণ বা গোটা শৌচাগারটি বানিয়ে দেওয়া সব কাজই করেন মহিলারা। বিডিও অফিস থেকে যে আগাম টাকা পাওয়া যায় তা থেকেই প্রতিদিনের মজুরি মিটিয়ে দেওয়া হয় মহিলাদের। যে সব মহিলারা মিস্ত্রির কাজ করেন তাঁরা প্রতিদিন ৩৫০ এবং জোগাড়ের কাজ করা মহিলারা ২৫০ টাকা করে পান।

সপ্তাহে সাত দিন কাজ করেন ময়না, রহিমা, পারভিনা, মুনমুনরা। কেউ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। কেউ আবার বাড়ির সব কাজ সেরে তবে আসেন। কেউ আবার তাঁদের স্বামীদেরও কাজ জুটিয়ে দিয়েছেন প্রকল্পের আওতায়। প্রশাসনের দাবি অনুযায়ী গোটা জেলায় ৪ টি মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় নির্মাণ সামগ্রী তৈরির। এই প্রকল্পের কাজ তো বেশিদিন থাকবে না। তখন কী ভাবে রোজগার করবেন?

হাঁসখালি দক্ষিণপাড়া ক্লাস্টর কমিটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে শেফালি বিশ্বাস, লক্ষ্মী হালদার, বুলবুলি বিশ্বাস, শিখা ঘোষ জানালেন, কাজ ঠিক জুটে যাবে। কারণ শৌচাগার তো সকলের লাগবেই। প্রতিবছর সংসার বাড়ছে। বহু পরিবার আলাদাও হচ্ছে, তাই একের বদলে দু’টি শৌচাগারের প্রয়োজন তো হবেই। পাশাপাশি অন্য জেলার থেকেও অনেক সময় বায়না আসছে। মহীশুড়ার একটি স্যানিটারি মার্টের তরফে জানা গেল পার্শ্ববর্তী মুর্শিদাবাদেও শুরু হয়েছে শৌচাগার নির্মাণের কাজ। সেই ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গেও আলোচনা চলছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement