সরু গলি, অজস্র বাড়ি, বিভিন্ন জায়গায় গজিয়ে ওঠা বহুতল--এই নিয়েই এখন বহরমপুর। নিজস্ব চিত্র।
তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘের আমন্ত্রণে বহরমপুর সূর্য সিনেমা হলে তৃপ্তি মিত্র ও শম্ভূ মিত্র অভিনীত বিজয় ভট্টাচার্যের নাটক নবান্ন মঞ্চস্থ হয়। তখন তো আর এখনকার মতো মঞ্চ গড়ে ওঠেনি। মঞ্চ বলতে তখন গ্রান্টহল। তাই সূর্য সিনেমা হলের মঞ্চে নবান্ন নাটককে ঘিরে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছেন বহরমপুরের আম জনতা।
এর মধ্যেই সামাজিক ও রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে গিয়েছে। ১৯৫৪ সালে জমিদারি প্রথা লোপ পায়। ‘বাবু’ সংস্কৃতিরও অবলুপ্তি ঘটে। দেশভাগের ফলে বহরমপুর শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মানুষের ভিড় বাড়ে। পূর্ববঙ্গের রীতিনীতি ও সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে বহরমপুরের নিজস্ব সংস্কৃতির উপরে। ফলে সব মিলিয়ে বহরমপুরের মানুষের মনন-মানসিকতার বদল ঘটে।
ইতিহাসের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বিষাণকুমার গুপ্ত জানান, সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি প্রথা, দেশভাগ, নকশাল আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উত্তাল রাজনৈতিক গণ আন্দোলনের ফলে ওই বদল স্বাভাবিক। এর ফলে মানুষের পুরনো ধ্যানধারণা, মানসিক ও মূল্যবোধেরও বদল ঘটে। তাঁর কথায়, “চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের যে শহর দেখেছি, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সেই শহরের বদল ঘটে গিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় আন্দোলিত হওয়ার ফলেই এই পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে ফিকে হয়ে গিয়েছে শহরের নিজস্ব ভাবধারা। বদল ঘটেছে খাদ্যাভ্যাসে-পোশাকে-বনেদি সংস্কৃতির ঘরানায়।”
সংস্কৃতিপ্রেমী বহরমপুবাসীর আন্দোলনের ফলে বহরমপুর শহরে মিস্ শেফালীর নাচ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখন? পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়েছে। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সোমেশ রায় বলেন, “এখন কেমন যেন ‘আমি ও আমার পরিবারের’ মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন মানুষ। এখন কেউ কারও জন্য নয়। ফলে একা ও নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন সেই সকল বৃদ্ধ বাবা-মা, যাঁদের সন্তান-সন্ততিরা অধিকাংশই কর্মসূত্রে বাইরে। ফলে বৃদ্ধা বাবা-মায়েরা কিছুটা হলেও নিঃসঙ্গতায় ভুগে টেলিভিশনের মেগা-সিরিয়ালে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। কারণ সেই পাড়া-সংস্কৃতি উধাও! ”
এ দিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কয়েক বছর ধরে ওপার বাংলার উদ্বাস্তু মানুষ বহরমপুর পুরসভা-লাগোয়া কৃষ্ণমাটি, হরিদাসমাটি, বলরামপুর, মণীন্দ্রনগর, গোয়ালজান-নিয়াল্লিশপাড়া এবং বহরমপুরের স্বর্ণময়ী, খাটিকতলা, মানকুমারী এলাকায় আশ্রয় খুঁজে নেয়। সেই সময়ে জলা-জঙ্গলে ভরা এলাকায় সামান্য দামে জমি কিনে জায়গা কিনে আস্তানা গড়ে তোলেন। পরে পায়ের নীচে মাটি শক্ত হলে তারা বহরমপুর পুরসভা এলাকায় জায়গা কিনে নতুন বসত গড়ে তোলেন। নগরায়ণের হারও বেড়েছে দ্রুত। ২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে যেখানে বহরমপুরের জনসংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৬০ হাজার ১৬২ জন, সেখানে ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে তা বেড়ে হয়েছে, ১ লক্ষ ৯৫ হাজার ৩৯৩ জন। গড়ে উঠেছে ফ্ল্যাট কালচার। এক সময়ে ইন্দ্রপ্রস্থের মত জলা-জঙ্গলে ভরা জায়গার দাম বেড়ে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। ইন্দ্রপ্রস্থ ছাড়াও নতুন একটা উপনগরী ইন্দ্রপুরী এলাকা গড়ে উঠেছে।
বহরমপুরের বুক চিরে বয়ে গিয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। যা বহরমপুরকে উত্তর শহরতলি ও দক্ষিণ শহরতলি এলাকায় ভাগ করেছে। উত্তর বহরমপুরের জনবিন্যাসের যে চরিত্র, তার সঙ্গে দক্ষিণ বহরমপুরের জনবিন্যাসের চরিত্রের বেশ কিছু ফারাক রয়েছে। এছাড়াও উত্তরের মানুষের মধ্যে কিছু সাবেকিয়ানার বহিঃপ্রকাশ বিশেষ ভাবে চোখে পড়ে, যা দক্ষিণের দেখা যায় না।
কেননা, অধিকাংশ পুরাতন জমিদার পরিবারের বাস উত্তর বহরমপুরে। জমিদারি আমলে ঘটা করে সাবেকি দুর্গাপুজোর রেওয়াজ ছিল। দোলযাত্রা-রথযাত্রা নিয়ে জমিদার পরিবারগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতারও চল ছিল। অন্য দিকে দক্ষিণে দু’একটি জমিদার পরিবারের খোঁজ করলে পাওয়া যায়। উত্তর বহরমপুরে এখন আর বারোয়ারি দুর্গাপুজো চোখে পড়ে না। যা রয়েছে তা সর্বজনীন। আর সাবেকি বারোয়ারি পুজোর চল দক্ষিণ বহরমপুরে না থাকারই কথা। কারণ, ব্রিটিশ আমলে ক্যান্টনমেন্ট থাকায় গোরাদের বাজার করার জায়গা থেকেই ‘গোরাবাজার’ নাম ও এলাকার উত্থান। তার উপরে দেশভাগের পরে উত্তর বহরমপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছিন্নমূল মানুষ বসত গড়ে তোলেন।স্থায়ী ভাবে যারা বাস করেন, তাদের সংখ্যা লক্ষাধিক হলেও তার বাইরে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতি দিন ব্যক্তিগত কাজে বা কেনাকাটার জন্য শহরে আসেন। তারা দিনের দিন এসে চলেও যান। তাদের জন্যও রাস্তাঘাটের উপরে প্রভাব পড়ে। এ দিকে জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিভিন্ন যানবাহনের সংখ্যাও। কিন্তু গত কয়েক বছরে নতুন কোনও রাস্তা তৈরি হয়নি। উল্টে রাস্তা বেদখল হয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে ‘পুকুর বুজিয়ে’, ‘ঐতিহাসিক’ বাড়ি ভেঙে বহুতল আবাসন গড়ে উঠছে।
রাজ্যের অন্যান্য শহরের মত এখানেও ইঁট-কাঠ-কংক্রিটের বহুতল বাড়ি গজিয়ে উঠেছে। অনেকটাই হয়তো প্রয়োজনের তাগিদে। পুরনো-নতুন এলাকা বাছ-বিচার না করেই প্রোমোটারের থাবা পড়ছে। আসলে বহরমপুরবাসীর জীবনযাত্রারও তো পরিবর্তন ঘটছে। ফলে নতুন চাহিদা মেনে, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করেই এই বহুতল বাড়ি গড়ে উঠছে।
তবে বনেদি শহর হলেও বহরমপুর শহরকে মূলত মধ্যবিত্ত টাউনশিপ বলেই অভিহিত করা যায়। বহরমপুর শহরে ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্ট থাকার ফলে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ নিরাপত্তার কারণে এখানে বাস করার জন্য চলে আসেন। তার উপরে ১৮০০ সালে বহরমপুর হেড কোয়ার্টার হিসেবে পরিগণিত হয়। তার উপরে সিপাহি বিদ্রোহের পরে সরকারি চাকরিতে ভারতীয়দের ঠাঁই হয়। ফলে করণিককুলের বৃদ্ধি পায়। জেলায় কোনও শিল্প গড়ে না ওঠায় সরকারি কর্মী-শিক্ষক-ব্যবসায়ীদের ভিড় বাড়তে থাকে শহরে। মধ্যবিত্ত মানুষের শহর হয়েই থেকে যায় বহরমপুর।
আশ্বিনের ভোরবেলায় গাছের তলায় ধরে থাকা শিউলিতে পুজো পুজো গন্ধ শুনতে পান না এখনকার বয়স্করা, সেই শিউলি গাছ কেটে সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল বাড়ি থেকে শপিং কমপ্লেক্স।