শহরে তৃণমূলনেত্রী। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
কাপ-প্লেটের সেটটা তুলে রাখবেন চৈতন্য ঘোষ। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর হোটেলে এসে এই কাপেই যে দু’দুবার চা খেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে যাতায়াতের পথে একাধিকবার কৃষ্ণনগরের চারগেট এলাকায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে তাঁর হোটেলে চা খেয়েছেন মমতা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও যে তিনি আসবেন, ভাবতে পারেননি চৈতন্যবাবু। ঘোরের মধ্যে রয়েছেন পাশের মিষ্টি দোকানের কর্মীরাও। সেখান থেকে ১০টি প্যাকেটে ৫ কেজি সরপুরিয়া কিনেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বৃহস্পতিবার মুর্শিদাবাদ থেকে কর্মিসভা করে রাত ৮টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী কৃষ্ণনগরে ঢুকেছিলেন। ওঠেন জাতীয় সড়কের পাশে একটি হোটেলে। কিছুক্ষণ পরে হোটেলের বাইরে হালকা হয়ে যায় পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমের ভিড়। রাত ১০টার কিছুু পরে আচমকাই ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে মমতা বেরিয়ে পড়েন হোটেল থেকে। সোজা চলে আসেন কিছুটা দূরে চারগেট এলাকায়, জাতীয় সড়কের পাশে যেখানে দাঁড়ায় দূর পাল্লার বাসগুলি। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ছোট-বড় হোটেল আছে। এমনই একটি হোটেলে ঢুকে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সময় ওই হোটেলে কর্মিসভার জন্য টিফিন তৈরির তদারকি করছিলেন দলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত, কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান অসীম সাহারা। দলনেত্রীকে দেখে হচকচিয়ে যান তাঁরাও। মুখ্যমন্ত্রী সোজা একটি টেবিলের চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়েন। চেয়ে নেন এক কাপ মিষ্টি কম দুধ চা।
চাকদহে বিধানসভা উপ নির্বাচনের তৃণমূল প্রার্থী রত্না ঘোষের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।
এরই মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর আসার খবর শুনে ভিড় জমাতে থাকেন আশপাশের হোটেল ও দোকানের কর্মী-মালিকরা। ওই হোটেলে তখন খাচ্ছিলেন কিছু পুলিশকর্মী। মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে কোনও রকমে খাওয়া শেষ করে তাঁরা হোটেলের বাইরে বেরিয়ে আসেন। পাশের হোটেলেই খাচ্ছিলেন এক দল শ্মশানযাত্রী। মাঝপথে খাওয়া ফেলে ছুটে আসেন তাঁরাও। ভাগ্যবান কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করার সুযোগ পান। ততক্ষণে তাঁকে ঘিরে বসে পড়েছেন গৌরীবাবু, অসীমবাবুরা। জেলা সভাপতির সঙ্গে জেলার সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে হালকা কথা সেরে নেন মমতা।
রাজনীতির কথা বলতে ওই টুকুই। বাকিটা সময় হাসি-মস্করার মেজাজে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। হোটেলের ম্যানেজার অমলেশ দাস বলেন, ‘‘অত রাতেও যেন মুখ্যমন্ত্রীর ফোনটা কিছুতেই থামতে চাইছিল না। অজস্র ফোন আসছিল। তিনি নিজেও অনেককে ফোন করছিলেন। মুনমুন সেনের সঙ্গে কথা বলার সময় রীতিমতো রসিকতা করেন।’’
মাঝখানে মমতা চলে যান পাশের হোটেলে। সেখানে হোটেল কর্মীদের কুশল জিজ্ঞাসা করে কিনে নেন সরপুরিয়া। ওই দোকানের ম্যানেজার বাসুদেব চক্রবর্তী জানান, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে বেশ কয়েকবার তাঁদের দোকান থেকে সরপুরিয়া কিনে নিয়ে গিয়েছেন মমতা। এ দিন মোট আড়াই হাজার টাকার মিষ্টি কেনেন তিনি।
মিষ্টি কেনার পর ফের আগের হোটেলে ফিরে এসে গল্প শুরু করেন মমতা। চেয়ে নেন আরও এক কাপ চা। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ কেউ মোবাইল ফোনে ছবি তোলার চেষ্টা করলে নিষেধ করেন নিরাপত্তাকর্মীরা। এইটুকু ছাড়া নিরাপত্তার কোনও কড়াকড়ি ছিল না। স্থানীয় হোটেল ও দোকানের মালিকরা তাঁদের সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। এদেরই একজন কাজল কর বলেন, “জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য আমাদের এখানে ফ্লাইওভার হওয়ার কথা। সেটা হলে বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়বেন। আমরা আমাদের কথা মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছি। উনি আমাদের কথা খুব মন দিয়ে শুনেছেন। আশা করছি এবার আমাদের সমস্যার সমাধান হবে।”
কিছু সময় থাকার পরে মমতা ফিরে যান শহরের হোটেলে। রাতের মেনুতে ছিল সামান্য সব্জি আর কাজলি ও কাতলা মাছের তরকারি। হোটেলের বাগানে কিছু সময় পায়চারি করে রাত একটা নাগাদ শুয়ে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী।
ঠিক সেই সময় মুখ্যমন্ত্রীর চায়ের কাপ ধুয়ে-মুছে তুলে রাখছিলেন হোটেলের মালিক চৈতন্য ঘোষের বছর পঁচিশের ছেলে সুফল। কাপ-প্লেটের সেট মুছতে মুছতে সুফল বলেন, ‘‘ভাবতেই পারছি না যে এভাবে মুখ্যমন্ত্রী নিরাপত্তার কড়াকড়ি ছাড়া আমাদের হোটেলে ঢুকে পড়বেন, বসে গল্প করবেন। পুরোটাই স্বপ্নের মতো লাগছে। এই কাপ তুলে রেখে দেব আমরা।”