ধুম মচা দে... ধুম মচা দে...
ট্রেনের আওয়াজ, ফিরিওয়ালাদের হাঁক ছাপিয়ে বেজে উঠল মোবাইলের রিংটোন। শনিবার সকালে কৃষ্ণনগরগামী লোকালে তখন চিড়েচ্যাপ্টা ভিড়। কোনও রকমে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে কল রিসিভ করলেন বছর ত্রিশের এক যুবক। গলায় শোক-দুঃখ ঢেলে দিয়ে ফোনের ও প্রান্তের এক বন্ধুকে কাতর গলায় বললেন, “দাদা বোধহয় আর ফিরবে না রে....।”
প্রথমে ধুম-মচানো রিংটোন, তারপর আবেগ-জড়িত সংলাপ, ওই যুবকের দিকে সকলেরই কৌতূহলী দৃষ্টি। প্রবল ভিড়ে জায়গা না-পাওয়া যাত্রীরা, যাঁরা এতক্ষণ ‘আরে একটু সরে দাঁড়ান না’ কিংবা ‘গেটে দাঁড়ালে কী করে হবে’ বলে হইহই করছিলেন তাঁরাও ওই যুবকের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। ফোনের ও প্রান্তের কথা শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু এ পারের বক্তা বলে চলেছেন, “আহাহা, মরতে যাবে কেন? কিন্তু ওই হতচ্ছাড়াগুলো কথা বলবে বলে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেমালুম কেমন গ্রেফতার করে ফেলল, দেখলি না? ওদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া কি সোজা?”
অন্য যাত্রীরা কিছুক্ষণ একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। তারপরেই কামরায় হোহো হাসির রব উঠল। ওই যুবকও মোবাইলে কথা বলতে বলতে তখন হাসছেন, “ধুস গাধা, এতক্ষণে বুঝতে পারলি কার কথা বলছিলাম?”
“জব্বর নাটকটা করলেন মশাই। আমিও তো প্রথমে ভেবেছিলাম আপনার দাদার বোধহয় সত্যিই কিছু হয়েছে।”-- ভিড়ের মধ্যে থেকেই মুখ বাড়িয়ে সহাস্য মন্তব্য এক প্রৌঢ়ের। সেই ফিল্মি কায়দায় ওই যুবকের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, “আরে উনি কি আমার একার দাদা? উনি তো সবার।” পাশ থেকে আরেকজনের ফুটনোট, “দাদা হারালে কি আর দাদা পাওয়া যায় রে পাগলা!”
ট্রেন ছুটতে থাকে। বাড়তে থাকে ভিড়, কথার পিঠে কথাও। ওই যুবকের রসবোধে মজে ততক্ষণে আলোচনায় যোগ দিয়েছেন আরও অনেকেই। এই একটু আগে যাঁরা ভিড় নিয়ে শাপ-শাপান্ত করছিলেন তাঁরাই ‘দাদা’-র আলোচনায় মশগুল। একজনের গলায় রাগ, “জেলে ঢোকার সময়েই নেতাজিকে টানতে হল?” অন্যজনের উত্তর, “আরে, ফ্রিডম হারাতে বসলেই তো ফ্রিডম ফাইটারদের কথা মনে পড়ে।” এমন সব চুটকি চলছে, আর হাসির তুফান উঠছে। বাদ যাচ্ছেন না ফিরিওয়ালারাও। এক চা বিক্রেতার সবিনয় নিবেদন, “দাদা কিন্তু আজ সকালে চা-বিস্কুট খেয়েছেন। এই দাদাদেরও চা দিই। গলাটা একটু ভিজিয়ে নিন।” ওই ভিড়ের মধ্যেও তখন চায়ের কাপে তুফান উঠেছে -- ‘এরপর কে?’ ‘ম’ এর পরে কি ‘মু’? দিল্লি থেকে যা খেল দেখাচ্ছেন ‘মো’। ‘এক-এক করে দাদাদের উইকেট যে ভাবে পড়ছে তারপরেও দিদির তো কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ছে না...’ বক্তারা নিজেদের গন্তব্যে নেমে যাচ্ছেন। উঠছেন নতুন লোকজন। তাঁদেরও কেউ কেউ যোগ দিচ্ছেন। গল্প ক্রমশ বেড়েই চলেছে। দমদম, ব্যারাকপুরের পরে নৈহাটিতে নেমে গিয়েছেন সেই যুবক। কাঁচড়াপাড়া, কল্যাণী পেরিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে শিমুরালির দিকে। তখনই জমজমাট সেই গল্পে তাল কাটলেন এক বৃদ্ধ। কী হল? তড়িঘড়ি বাঙ্ক থেকে ব্যাগ নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “কী আর হবে! গল্পে গল্পে স্টেশন পেরিয়ে এসেছি। এখন আবার ফিরতি ট্রেন ধরতে হবে!”
কোথায় নামতেন তিনি? স্টেশনের নাম মদনপুর।