পুজোর বাজার। ভর সন্ধ্যায় জমাট ভিড়ে শহরের রাস্তায় হাঁটা দায়। ছোট-বড় সব বয়সের পুরুষ-মহিলাদের ভিড়টা যেন চাপ ধরে আছে পোড়ামাতলা, বাজাররোড, রাধাবাজার, বউবাজার, ষষ্ঠীতলা, ঢপওয়ালির মোড়, হরিসভা পাড়ার রাস্তায়। তার সঙ্গে রিক্সা, ভ্যানরিক্সা ও ব্যাটারিচালিত টুকটুকের যাতায়াত মিলে সে এক দুঃসহ অবস্থা। এমন সময়েই ভিড়ের মধ্যে পিলে চমকে দিয়ে হই হই করে হাজির থ্রি-কোয়াটার বা হাফ প্যান্ট সঙ্গে গেঞ্জি পরা একদল মোটরবাইক বাহিনী। পায়ে হাল ফ্যাশানের মোটা হাওয়াই চপ্পল বা শু। মোবাইলের ইয়ার প্লাগ গোঁজা কানে, মুখ ভর্তি পানমশলা, কখনও ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট। বিরাট চেহারার মোটরবাইকে দু’তিনজনে বসে সাইকেল গলতে পারে না এমন ফাঁক দিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে বাইক ছুটিয়ে সশব্দে মিলিয়ে যাওয়াতেই যেন তাদের সার্থকতা। কেউ পড়ে গেলে বা ভয় পেলে তাদের ফুর্তির শেষ থাকে না। ছোটখাট দুর্ঘটনা তো লেগেই রয়েছে। তবে এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে বিপদ বাড়ে বই কমে না।
পুরানো শহরের ভিড়ে ঠাসা ঘিঞ্জি রাস্তা দিয়ে ফিল্মি কায়দায় ঝড় তুলে মোটরবাইক ছোটানো বেশ কিছুদিন ধরেই নবদ্বীপের মানুষের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তীব্র গতি এবং সঙ্গে কান ফাটানো শব্দে মেয়েদের স্কুল, কলেজের সামনে অথবা গৃহশিক্ষকের বাড়ির মুখে মোটরবাইক রোমিওদের সকাল বিকাল নিয়মমাফিক ছোটাছুটিতে জেরবার সাধারণ মানুষ। মোটরবাইকের দাপাদাপিতে শহরের বেশ কিছু রাস্তায় হাঁটাচলা এড়িয়ে চলছেন বহু মানুষ বিশেষ করে প্রবীণ এবং মহিলারা। ছোটদের স্কুলে বা পড়তে পাঠিয়ে বাড়ি না ফেরা অবধি চিন্তায় থাকেন অভিভাবকেরা। তবে শুধু সাধারণ মানুষের উদ্বেগ নয়, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুঘর্টনার সংখ্যাও।
৯ সেপ্টেম্বর,মঙ্গলবার গভীর রাতে তেঘরি বাজারে মদ্যপ অবস্থায় মোটরবাইক চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম এক যুবক। পরদিনই একই ভাবে মদ্যপ অবস্থায় মোটরবাইক চালাতে গিয়ে নবদ্বীপের নিমতলায় বাতিস্তম্ভে ধাক্কা মেরে ঘটনাস্থলে মারা যান বছর কুড়ির এক যুবক। আহত হন, আহত আরও এক আরোহী। মাস খানেক আগে বেপরোয়া বাইকের ধাক্কায় বাড়ি ফেরার সময় মারা যান প্রাচীন মায়াপুরে ৭১ বছরের এক সাইকেল আরোহী। তারও আগে অক্ষয় তৃতীয়ার রাতে তেঘড়ী পাড়ায় মদ্যপ অবস্থায় মোটরবাইক চালিয়ে বাতিস্তম্ভে ধাক্কা মেরে ঘটনাস্থলেই মারা যান আরোহী। দুদিন পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় অন্য আরোহীর।
শহরের বিভিন্ন মোটর গ্যারেজ সূত্রে খবর, শুধু জোরে মোটর বাইক চালানোই নয়, জোরে মোটরবাইক থামানোর জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা নেয় বাইক রোমিওর দল। এখনকার বাইকের বেশির ভাগই ডিস্ক ব্রেক। সেই ব্রেক একটু টাইট হলে খুব জোরালো গতিতে চলতে চলতে মোটরবাইক চট করে থামানো যায়। আর তাতে পিছনের চাকাটা একটু পিছলে ঘুরে গিয়ে থামে। অনেকটা সিনেমার কায়দায়। চাকার ব্রেক টাইট করানো এখন খুব চল। তাছাড়া নবদ্বীপ শহরকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে বর্ধমান জেলার এসটিকেকে রোড। সন্ধ্যার পরে বা একটু রাতের দিকে ওই রাজ্য সড়কের দু’পাশের লাইন হোটেলে বাইক নিয়ে মদ খেতে যাওয়া এক শ্রেণির যুবকের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে ফেরার পথে।
কিন্তু কেনই বা মোটরবাইক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা। এ নিয়ে নবদ্বীপের নানা মহলে ক্ষোভ চরমে। নবদ্বীপ নাগরিক কমিটির সম্পাদক এবং আইনজীবী দিলীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “পুলিশের হাতে মোটরবাইক নিয়ন্ত্রণের প্রচুর ক্ষমতা আইনে দেওয়া আছে। মোটর ভেহিকেল অ্যাক্ট অনুযায়ী মোটরবাইকে দু’জনের বেশি তিনজন চড়লে বা হেলমেট ছাড়া বাইক চালালে পুলিশ ১০০০ টাকা স্পট ফাইন করতে পারে। শহরের মধ্যে ৪০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বাইক চালানো নিষিদ্ধ। শুধু তাই নয় মোটরবাইক চালকের পোশাক, জুতো, বাইকের সাইলেন্সারের শব্দ, আলো সব কিছুর জন্য আইন আছে। পুলিশ মনে করলে আইনি পথেই মোটরবাইকের তাণ্ডব বন্ধ করতে পারে। তবে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা পেরিয়ে কতটা পারবে সেটাই কথা।”
নবদ্বীপের পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা বলেন, “যে ভাবেই ঘটুক না কেন যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। শহরের মোটরবাইকের তাণ্ডব ঠেকাতে পুলিশকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছি। নিয়ম না মেনে দ্রুত গতিতে এবং অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় মোটরবাইক চালালেই পুলিশ গ্রেফতার করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। বিষয়টি জেলার পুলিশ সুপারকেও জানিয়েছি। এভাবে মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।”
রবিবার সন্ধ্যার পরে মোটরবাইক ধরতে অভিযানে নামে পুলিশ। দশটি মোটরবাইক এবং তাদের আরোহীদের বিভিন্ন রাস্তা থেকে ধরে পুলিশ। তবে সাদা পোষাকে থাকা পুলিশকে প্রথমে অভ্যাসবশত গুরুত্ব দেয়নি মোটরবাইকের বাহিনী। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার গলা উঁচিয়ে খোদ আইসি’কেই প্রশ্ন করে বসে, “এ সব নিয়ে কথা বলার আপনি কে?” নবদ্বীপের আইসি তপন কুমার মিশ্র বলেন, “আমরা শহর জুড়ে মোটরবাইক নিয়ন্ত্রণ অভিযান শুরু করছি। যে কোনও সময়ে যে কোনও জায়গায় পুলিশ হানা দেবে।”