“দেখ, তুমি আসবে বলে নিজে বসে বসে সব নোট করেছি। এই পয়েন্টগুলো একটু পড়বে কিন্তু।”
তেহট্টের গ্রামে প্রচারের পথে যেতে যেতে গাড়িতে বসেই অঙ্ক খাতার পাতাগুলি ছিঁড়ে হাতে ধরিয়ে দিলেন তাপস পাল। যা লেখা, সবই বিজেপি প্রার্থী সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। তিনি কী কী ‘ভুল’ করেছেন এবং কী কী ‘কাজ’ করেননি, তার তিক্ত ফিরিস্তি।
সত্য বটে, এই কেন্দ্রে এ বার নিয়ে চার বার লড়ছেন সত্যব্রত। জিতেছেন এক বারই, ১৯৯৯-তে। বাকি তিন বার ভোট কিছু পেলেও জয়-পরাজয়ের ধর্তব্যে তাঁকে ভাবা হতো না। কিন্তু এ বার লড়াইয়ের বাস্তবতা তাঁকে এতটাই আলোকবৃত্তে এনে ফেলেছে যে, তাপসের দেওয়া নোটে শুধুই ‘সত্য’যুগের আখ্যান! যার অর্থ, দেশে মোদী-হাওয়া নামক যে আবেগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বলে খবর, তাপসের পালে সেই বাতাসই হানা দিচ্ছে।
কলকাতায় তাপপ্রবাহ চললে কৃষ্ণনগর মুক্ত থাকবে কেমন করে! শহরে এম এম ঘোষ রোডে রাস্তার পাশে বেঞ্চি পেতে বসা সান্ধ্য-আড্ডায় তাপস-সত্যব্রত ইত্যাদি তাই রীতিমতো হট টপিক। দুপুরে সিপিএম প্রার্থীর মনোনয়ন পেশের মিছিল কত লম্বা হয়েছিল, কংগ্রেস কেন মুসলিম মহিলাকে প্রার্থী করল দাবি-পাল্টা দাবির উত্তেজনা তা নিয়েও। ব্যারিস্টার সত্যব্রতবাবুর শিক্ষা-দীক্ষা-আভিজাত্য থেকে শুরু করে তাপস পালের ‘দাদার কীর্তি’ কিছুই আলোচনায় বাদ নেই। সঙ্গে নানান মিঠেকড়া রসিকতা, যা কেবল রকের আড্ডাতেই প্রাণ পায়।
তবে কি এ বার ফুলে ছাপ? হাসতে হাসতে সাদা হাফ শার্ট-প্যান্ট পরা মাঝবয়সির দাবি: “হতেই পারে। কিন্তু এক ফুল, না জোড়া ফুল সেটা কিছুতেই বলব না!” তাঁর চারপাশের জমায়েতটাও সমস্বরে হেসে সমর্থন জোগাল তাঁকে।
তেহট্ট রোডের শরীর বেয়ে গরম হাওয়ার হলকা। রোদ পড়ে এলেও তাপ জুড়োয় না। কেমন একটা শুকনো দমবন্ধ গুমোট। পিচ রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে বেশ কিছুটা ভিতরে গ্রামের মাঠে বক্তৃতা করছিলেন তৃণমূল প্রার্থী তাপস পাল। নেতাসুলভ সাদা কুর্তা-পাজামা, গলায় সভায় পাওয়া সাদা বেলফুলের মালা। রোদে পোড়া, ঘামে ভেজা শ্রান্ত মুখ। জমায়েত নিরাশ হওয়ার মতো নয়। গুছিয়ে রাজনৈতিক ভাষণ দেওয়া গত পাঁচ বছরে বেশ রপ্ত করে ফেলেছেন সাংসদ-অভিনেতা তাপস। গলা কখনও চড়ায়, কখনও খাদে, কখনও কাঁদে!
গলা চড়িয়ে প্রার্থী বলেন, “আমার গত বারের সাংসদ তহবিলের ২৫ কোটির মধ্যে ২২ কোটি আমি আপনাদের জন্য এই কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকল্পে খরচ করেছি। এ ছাড়াও আপনাদের নানা প্রয়োজনে আমি আরও ৪ কোটির ব্যবস্থা করে দিয়েছি।” তার পরেই আবেগে কাঁদো কাঁদো: “কিন্তু যখন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরি, এক জনও এগিয়ে এসে বলেন না, স্যর কিংবা দাদা কিংবা তাপস কিংবা তাপসবাবু, আপনি আমাকে ৫০ হাজার টাকা পাইয়ে দিয়েছিলেন! অবশ্য তাতে আমার কোনও দুঃখ নেই। আপনাদের জন্য কাজ করতে পেরেছি, তাতেই আমি খুশি।”
চটাপট হাততালি শুনতে শুনতে পরের মিটিঁংয়ে চলে যান তাপস। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামের পথে দাঁড়িয়ে থাকা ভিড় বারবার তাঁর গাড়ি থামিয়ে দেয়। সামনের গাড়ি থেকে লম্বা তারের হ্যান্ডমাইক পিছনের গাড়িতে চলে আসে। দুটো কথাও বলতে হয়। এবং একই সঙ্গে নিজের মনকে তিনি বোঝান, তৃণমূলের তকমা ছাড়াও ‘তারকা’ তাপস পালের একটা বাড়তি টান আছে!
এই তাপসকে এ বার ফের প্রার্থী করা, না-করা নিয়ে তৃণমূলের একটি মহলে অনেক দিন ধরেই নানা সংশয় ঘুরপাক খাচ্ছিল। অন্য অনেক কারণের সঙ্গে কুণাল ঘোষ-সোমেন মিত্রের পাশে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দল ও নেতা-নেত্রীর সমালোচনা সেই সন্দেহে আরও অক্সিজেন জোগায়। তাপস অবশ্য এ জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। মমতাও স্থিতাবস্থা বজায় রেখেছেন।
কিন্তু তাতে ওপরতলার নেতাদের সঙ্গে তাপসের অর্ধ-শীতল সম্পর্কের যে খুব উন্নতি হয়েছে, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। তাঁর জন্য যাঁরা মাঠে নেমেছেন, সেই তৃণমূল স্তরের লোকেরাও অনেকেই জানেন সাংসদ হওয়ার পর থেকে জেলায় নেতা-এমএলএ ইত্যাদির বাইরে নিজের মতো করে গোষ্ঠী তৈরি করে নিয়েছিলেন তাপস পাল। সাংসদের অফিস খুলেছিলেন কলকাতার নিজাম প্যালেসে। তাঁর এলাকার বিধায়কেরা ভাবতেন, ‘সাংসদ যোগাযোগ রাখেন না’। সাংসদ ভাবতেন, ‘আমি কেন ফোন করব’! যার ফলে তৈরি হয়েছিল দূরত্ব। তাপস নিজে এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল। সেই ফাটল পুরোপুরি জুড়েছে, তা-ও বলা যাবে না। তবে দলেরই এক দায়িত্ববান জেলা নেতার মন্তব্য: “ভোট তো দেয় সাধারণ মানুষ। নেতাদের নিয়ন্ত্রণ সেখানে কতদূর কাজ করবে? মানুষের কাছে তাপসের গ্রহণযোগ্যতা কমেনি। জয়ের ব্যবধানও এ বার বাড়বে।”
সেই সাধারণ মানুষই কিন্তু আশি পেরনো সত্যব্রত (জলু) মুখোপাধ্যায়কে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে রাত দশটা পর্যন্ত। বিকেলবেলায় পদযাত্রা দিয়ে শুরু করে রাত ন’টায় বিজেপি প্রার্থী যখন শহর-লাগোয়া গোবরাপোতায় হাল্কা ভিড়ের পঞ্চম সভাটি করছেন, তখনও তাঁর আরও দুটি সভা করা বাকি। এই বয়সে পারছেন সামলাতে? তাঁর জবাব: “আমি তো দিব্যি পারছি। একদম পঁচিশ বছরের যুবকের মতো!” পাশে দাঁড়িয়ে দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মহাদেব সরকারের সংযোজন: “আপনি কি জানেন, অর্জুন যখন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ করেছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৭৭! যা বলছি মিলিয়ে নেবেন।” জলুবাবু অবশ্য এই অর্জুন-বিতর্কে জড়াননি। বরং গত বার দ্বিতীয় দফা ভোটে হারার পরে তিনি রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিতে চেয়েছিলেন বলে তাপসবাবুর প্রচার উড়িয়ে দিতে গিয়ে বলেছেন, “আমি সেই সন্ন্যাস বলিনি। দলের পদ না-নেওয়ার কথা বলেছিলাম।” আর বলেছেন, সংখ্যালঘুরাও (এই কেন্দ্রে মুসলিম ভোটার ৩৫ শতাংশের আশপাশে) দলে দলে বেরিয়ে আসছেন তাঁকে স্বাগত জানাতে।
এই হাওয়াই গত বার ৭৬ হাজার ভোটে জেতা তাপসকে কিঞ্চিৎ অস্থির করে রেখেছে। তাঁর ফোন যাচ্ছে বিধায়কদের বাড়িতে। তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরে ফাঁকফোকর ভরাটের জন্য কোমর বেঁধে নামতে হয়েছে নেতাদের। নাজিরপুরে দলের ছিটকা আঞ্চলিক কার্যালয়ে চোখে পড়ল তেমনই এক খণ্ডচিত্র।
নদিয়ার তৃণমূল সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত তেহট্টের নেতা তাপস সাহাকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, “তোর ওপর কিন্তু এখন গোটা এলাকার দায়িত্ব। দেখে রাখতে হবে।” ইনি সেই তাপস, ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে তেহট্ট কেন্দ্রে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে যিনি গৌরীশঙ্করের হার নিশ্চিত করেন।
রামভক্ত হনুমানের অজস্র ছবিতে তৃণমূলের অফিসটি সাজানো। ঠিক মাঝখানে গন্ধমাদনের বোঝা মাথায় হনুমান। সেই ঘরে প্রায় নতজানু তাপস তাঁর জেলা-সভাপতিকে কথা দিলেন: “কোনও ভুল হবে না, দাদা। এ বার আপনি দেখে নেবেন।”