ঝুলন উৎসবে পর্যটকের ভিড়, মন্দা কাটছে নবদ্বীপের ব্যবসায়

মাহ শাওন, করিব ঝুলন লাড়িলি কুণ্ডের তীরে বুধবার থেকে বৈষ্ণব পদাবলীর এই সুরে সুর মিলিয়েছে চৈতন্যধাম নবদ্বীপ। ঝুলন রঙ্গে মেতে উঠেছে বৈষ্ণবদের গুপ্ত বৃন্দাবন। নবদ্বীপের ছোট-বড় মঠমন্দির থেকে শুরু করে ক্লাব বারোয়ারি এমনকী ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ঝুলন উদ্যাপন হয় জাঁকজমক করেই।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৪ ০১:৪২
Share:

নবদ্বীপ উডবার্ন রোডের মোহন্তবাড়ির বিগ্রহ সেজেছে ঝুলনের সাজে। —নিজস্ব চিত্র।

মাহ শাওন, করিব ঝুলন লাড়িলি কুণ্ডের তীরে বুধবার থেকে বৈষ্ণব পদাবলীর এই সুরে সুর মিলিয়েছে চৈতন্যধাম নবদ্বীপ। ঝুলন রঙ্গে মেতে উঠেছে বৈষ্ণবদের গুপ্ত বৃন্দাবন। নবদ্বীপের ছোট-বড় মঠমন্দির থেকে শুরু করে ক্লাব বারোয়ারি এমনকী ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ঝুলন উদ্যাপন হয় জাঁকজমক করেই।

Advertisement

ক্যালেন্ডারের পাতায় অথবা পঞ্জিকার হিসেবে ঝুলন পাঁচ দিনের উৎসব। কিন্তু প্রচলিত প্রথা মেনে উৎসব শুরু হয়ে যায় শ্রাবণের শুক্লা প্রতিপদ থেকেই। ফলে উৎসব এবং পর্যটন নির্ভর স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যকে বর্ষার মন্দা মরসুমে কিছুটা হলেও রসদ জোগায় এই ঝুলন। রাস বা দোলের মতো নয়, পাঁচ দিনের ঝুলনযাত্রা বর্ণময়তা আর বৈচিত্র্যে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মেজাজের উৎসব।

ভিন্ন মেজাজেই এখানে হয় ‘মানুষ ঝুলন’ যা রাধাকৃষ্ণময় বৈষ্ণবীয় উৎসবকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। দশ থেকে পনেরো মিনিটের নাট্যাংশের অভিনয়। তাতে পুরাণ, রামায়ণ-মহাভারত থেকে কেদারনাথের প্রাকৃতিক বিপর্যয় সবই থাকতে পারে। এক-এক সন্ধ্যায় এক বা একাধিক বিষয়ের অভিনয়। একবার অভিনয়ের পরে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে পরবর্তী ‘শো’। কুশীলবেরা বেশিরভাগই এলাকার ছেলেমেয়ে। তবে কোন দিন কী পালা হবে তা নিয়ে আগে থেকে মুখ খুলতে চান না কোনও উদ্যোক্তাই। কারণ চুরি হয়ে যেতে পারে ‘থিম’। সুতরাং ঝুলন শুরু হলে তবেই পর্দা উঠবে।

Advertisement

তবে ৩০ তম বর্ষের পোড়াঘাটের নবমিলন সঙ্ঘ বা ৩৬তম বর্ষের বড়ালঘাটের জাহ্নবীপাড়া যুব শক্তি ক্লাব অবশ্য জানিয়ে দিয়েছিল তাদের ‘মানুষ ঝুলনে’র থিম। নবমিলন সঙ্ঘের মণ্ডপের থিম ‘অন্নপূর্ণার ঘট’। প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকছে সাম্প্রতিক থেকে পৌরাণিক বিভিন্ন বিষয়ের অভিনয়। সুজয় ঘোষ, মদন রজকেরা জানান এবারে তাঁদের বাজেট প্রায় এক লক্ষ তিরিশ হাজার টাকা। অন্য দিকে জাহ্নবীপাড়া যুবশক্তি ক্লাবের ভরত পাল ও গৌর দাস জানিয়েছেন, তাঁদের বাজেট এক লাখ বিশ হাজারের মতো। গীতার নানা অংশের অভিনয়ের পাশাপাশি থাকবে সামজিক বিষয়ও।

নবদ্বীপের মঠমন্দিরে আবার ঝুলনের ভিন্ন মেজাজ। গোবিন্দবাড়ি, বলদেব বাড়ি, গোরাচাঁদের আখড়া, রাধা মদনমোহন মন্দির, মোহন্ত বাড়ি, জন্মস্থান আশ্রম উৎসব মুখর। মহাপ্রভু মন্দির, সমাজবাড়িতে উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে অনেক আগে। মহাপ্রভু মন্দিরের ঝুলনের উৎসব চলে প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমাএক পক্ষকাল। ঝুলন এখানে রাধাকৃষ্ণের নয়, মহাপ্রভুর। প্রতিদিন ঝুলন কীর্তন ও পাঠের বিশেষ আসর বসে। নবদ্বীপের হরিসভা মন্দিরের প্রধান বিবেকবন্ধু ব্রহ্মচারী বলেন, “ঝুলনের শেষ পাঁচ দিন মহাপ্রভুকে সাজানো হয় পাঁচটি বিশেষ বেশে। একাদশীর দিন নটবর বেশ, দ্বাদশীর দিন নাটুয়া বেশ, ত্রয়োদশীর রাখাল বেশ, চতুর্দশীর দিন নাগরী বেশ এবং পূর্ণিমার দিন রাজবেশ।”

সমাজবাড়ির ঝুলন তেরো দিনের। বৃন্দাবনের গোস্বামী মতে এখানে ঝুলনযাত্রা উদ্যাপন করা হয়। প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত হয় সায়ংকালীন ঝুলন। আর একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত সারারাত ঝুলন কীর্তন হয়। সঙ্গে সখী বেশে অভিনয়। কীর্তনে যা বলা আছে তাই অভিনয় করা হয়।

কখনও রিমঝিম আবার কখনও অঝোর বৃষ্টিতে মাখামাখি শহরের পথঘাট মঠমন্দির। মন্দিরময় নবদ্বীপের আনাচ কানাচ, গলি থেকে রাজপথে শোনা যাচ্ছে মল্লার কিংবা কেদারের সুর। সন্ধ্যা নামলেই জয়জয়ন্তীতে বাঁধা ঝুলন কীর্তনের মহাজনী পদ ভেসে আসে কোনও না কোনও নাট মন্দির থেকে। সঙ্গে শ্রীখোলে ‘দশকুসি’ বা ‘চঞ্চুপুটের’ বোল। মন্দিরের গর্ভগৃহে কামিনী, জুঁই, বেলফুলে সাজানো দোলনায় রাধাকৃষ্ণ অথবা মহাপ্রভুর মূর্তি। অগুরু চন্দনের গন্ধ, ধূপের পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তাঁর নানা রকম বেশ কোনও দিন মালিনী তো কোনও দিন গোয়ালিনী। আর সেই বিগ্রহের সামনে বসেছে আসর। চলছে ঝুলনলীলার গীতাভিনয়। মানুষ বুঁদ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনছেন, “শাওন মাস গগনে ঘন গরজন, দীপিত দামিনী মাল/ বরখত বারি, পবন মৃদু মন্দহি গঙ্গতরঙ্গ বিশাল।” এলাকাবাসীর মতে, নবদ্বীপের ঝুলন আসলে দুর্গা পুজোর প্রাথমিক মহড়া। শহর জুড়ে পাঁচ দিনের উৎসবে সেই চেনা শারদ উৎসবের গন্ধ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement