দশ ফুট বাই পাঁচ ফুটের ছোট্ট টিনের চালের ঘরটার এক দিকে কাঠের আলনার উপরে এলোমেলো ভাবে ছড়ানো পিলুর জামা-প্যান্ট। তার মধ্যে আকাশি-সাদা জামাটা ছিল তার সব চাইতে প্রিয়। রাতভর সেই জামাটার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদেছেন পুলুর মা রমাদেবী। কাঠের টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা ইতিহাসের বই, টেস্ট পেপার আর নীল কাগজে যত্ন করে মলাট দেওয়া পরিবেশবিদ্যার খাতা। পড়ন্ত বিকেলবেলা ফুলিয়ার নিহত ছাত্র অজয় ঘোষ ওরফে পিলুর বাড়িতে ঢুকে মনে হচ্ছিল, এখনই যেন খেলা শেষে দৌড়ে এসে পড়তে বসবে সে।
বুধবার বিকেল ৫টা নাগাদ নদিয়া জেলার শান্তিপুরের ফুলিয়া বিদ্যামন্দিরে ঢুকে একাদশ শ্রেণির ছাত্র অজয় ঘোষকে (১৭) মাথায় গুলি করে পালায় একদল যুবক। খবর পেয়েই রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে ছুটে যান বাড়ির লোক ও পড়শিরা। হাসপাতালে মৃত ঘোষণা করে দেওয়ার পর গোটা গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে।
বৃহস্পতিবার সকালে অজয়ের বাড়িতে ছুটে আসেন রানাঘাট উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্রের বিধায়ক তৃণমূলের পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায় ও নদিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি বানীকুমার রায়। তাঁরা অজয়ের বাবা-মার সঙ্গে কথা বলে সুবিচার দেওয়া ও পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। সমবেদনা জানাতে আসেন বামফ্রন্টের প্রতিনিধিরাও। ঘটনার দিন রক্তাক্ত অজয়ের ধারে-কাছে না ঘেঁষলেও এ দিন ফুলিয়া বিদ্যামন্দিরের তিন জন শিক্ষিকা (মাত্র) এসে দেখা করে যান। এরই মধ্যে শান্তিপুর ব্লক অফিস থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত শোক মিছিল বের করেন এলাকার বাসিন্দারা। মিছিলে পা মেলাতে দেখা যায় এলাকার তৃণমূল নেতাদেরও।
ব্লক অফিস, চায়ের দোকান, পাড়ায় পাড়ায়, মোড়ে-মোড়েএই একই আলোচনা। কিন্তু সবই কানে-কানে। অজয়ের খুনের বিষয় নিয়ে এলাকার কেউই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নন। সর্বত্রই যেন একটা আতঙ্কের পরিবেশ। সকলেরই চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। জোরাজুরি করলে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘আমাদেরও তো প্রাণের মায়া আছে। একটার পর একটা খুন হয়ে যাচ্ছে। স্কুলের ভিতরে ঢুকে ছাত্রকে গুলি করে খুন করল। সবই স্থানীয় দুষ্কৃতী। সবাই সবাইকে চেনে। এরপরও কী করে প্রকাশ্য মুখ খুলি বলুন তো।’’
ওই ব্যবসায়ী খুলে না বললেও এলাকার সিপিএম নেতারা কিন্তু সরাসরি শাসকদল তৃণমূলের দিকেই আঙুল তুলছে। অজয়-খুনে ধৃত দুর্জয় সরকার স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি তপন সরকারের খুড়তুতো ভাইপো। অন্য দুই অভিযুক্ত গোবিন্দ দাস ও কালু দত্তও ‘তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী’ বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। শান্তিপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক শান্তনু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। শাসকদল নিজেদের স্বার্থে এই সমাজ-বিরোধীদের ব্যবহার করছে। ফুলিয়া যেন সমাজ-বিরোধীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এই ছাত্রকে যারা খুন করেছে তারাও তৃণমূল আশ্রিত সমাজবিরোধী।’’ যদিও শান্তিপুর পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি তৃণমূলের রঘুনাথ চট্টোপাধ্যায় দাবি করেন, ‘‘যারা এই খুনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, তারা কেউই আমাদের দলের সঙ্গে জড়িত নয়। তারা সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতী।’’
এদিন ফুলিয়ার স্কুলগুলিতে নির্বিঘ্নে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হলেও শিক্ষক-শিক্ষিকারা আতঙ্কে কথা বলতে চাননি। অজয় হত্যাকাণ্ডে ধৃত দুর্জয় সরকারের স্কুল ফুলিয়া শিক্ষানিকেতনের প্রধান শিক্ষক দেবদাস ভাদুড়ি বলেন, ‘‘আমরা স্তম্ভিত। ছাত্ররা যে এমন কাজ করতে পারে তা যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। ভাবতেই পারছি না যে আমার স্কুলের কোনও ছাত্র এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। সকলেই খুব আতঙ্কিত।’’ ছাত্র-ছাত্রীরাও দুর্জয়কে না চেনার ‘ভান’ করছে। এ দিন সন্ধ্যা নামার একটু আগে বাড়িতে আসে অজয়ের মৃতদেহ। আশপাশে তখন কোনও সহপাঠী বা স্কুলের কেউ নেই। পড়শি বধূর কথায়, ‘‘সহপাঠীরা আসবে কী করে? সকলেই প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে আছে। থানা-পুলিশের ভয়ে দূরে দূরে থাকছে।’’
এরই মধ্যে অজয়ের স্কুল ফুলিয়া বিদ্যামন্দিরের কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন এলাকাবাসী। তাঁদের অভিযোগ, মাঝে-মধ্যেই ওই স্কুলের ভিতরে বাইরের ছেলেরা ঢুকে পড়ে। এর আগেও ওই স্কুলে ছোটখাটো গণ্ডগোলের ঘটনা ঘটেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ কখনওই কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক অসিত মণ্ডল অবশ্য বলেন, ‘‘এর আগে আমাকে ছাত্ররা কিছু জানায়নি। তাই আমিও পুলিশকে কিছু জানাতে পারিনি। আমাদের একজন দারোয়ান আছেন। তিনি অসুস্থ বলে আসছেন না যদিও। আমরাও ভাবতে পারিনি যে ছাত্ররা এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে।’’
জেলার পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমণ মিশ্র “ফুলিয়া এলাকাতে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের জন্য অভিযান চলবে” বলে জানিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতাদের চাপানউতোর কিংবা পুলিশ-প্রশাসনের আশ্বাসকোনওটাই আশ্বস্ত করতে পারছে না এলাকার লোকজনদের। থমথমে ফুলিয়া জানান দিচ্ছিল, ভাল নেই তারা।