রাজ্য সরকারি কমর্চারীদের নিয়ে গঠিত তৃণমূলের সংগঠন ‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারি ফেডারেশন’-এর মুর্শিদাবাদ জেলা সম্মেলনকে ঘিরে ফের প্রকাশ্যে এল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব।
রবিবার বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে প্রথম ওই জেলা সম্মেলন হল। সম্মেলনের বিরোধিতায় সরব তৃণমূলের সরকারি কমর্চারী সংগঠনেরই একটি গোষ্ঠী। আয়োজনের ‘বৈধতা’ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
যদিও মাস খানেক আগে ওই জেলা সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছিল, তখনই সংগঠনেরই অন্য একটি গোষ্ঠী ‘সম্মেলন বন্ধ হোক’ বলে দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠিও পাঠায়। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্ব ‘কাজিয়া’ ঠেকাতে দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে রফাসূত্র বের করার কোনও সদিচ্ছা দেখায়নি বলে অভিযোগ। ফলে ঘটা করে এক পক্ষ এদিন জেলা সম্মেলন করলেও উল্লেখযোগ্য ভাবে চোখে পড়েছে অন্য গোষ্ঠীর অনুপস্থিতি।
তা নিয়ে সম্মেলনে আসা সরকারি কর্মীদের মধ্যেও ফিসফাস শোনা গিয়েছে। তৃণমূল জেলা নেতৃত্বের বক্তব্যেও বিষয়টি উঠে এসেছে। মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি উজ্জ্বল মণ্ডল প্রকাশ্যেই বলেন, “সংগঠনের মধ্যে কোনও উপদল থাকবে না। একটাই সংগঠন থাকবে। সেই সংগঠনের নাম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারি ফেডারেশন এবং ওই সংগঠনের মধ্যে থেকে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।”
কিন্তু বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর নেতা নিলয় বাগচির সাফ কথা, “আমরা ওই জেলা সম্মেলনের বিরোধিতা করছি। আমাদের রাজ্য স্তরে কোনও কমিটি গঠন হয়নি। এমনকী সদস্য পদ গ্রহণের জন্য ফর্ম বিলির কাজও শুরু হয়নি। এই অবস্থায় জেলা সম্মেলন আয়োজনেরও কোনও বৈধতা নেই।”
কেন ওই সম্মেলন? তার কারণও নিলয়বাবু ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, “এর আগে ইন্দ্রনীল সেনকে সামনে রেখে মুর্শিদাবাদ জেলায় একটি কমিটি গঠিত হয়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী মনোজ চক্রবর্তী ছিলেন ওই সংগঠনের সভাপতি। যদিও অবসরপ্রাপ্ত কোনও কর্মী সদস্য পদ গ্রহণ করতে পারেন না। কিন্তু অবৈধ ভাবে ওই কমিটি গঠনের ফলে তা অনুমোদন দেননি সংগঠনের উপদেষ্টা তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ফের জেলা সম্মেলন আয়োজনের মধ্যে দিয়ে সরকারি কর্মীদের ওই সংগঠনকে কুক্ষিগত করতে চাইছেন নেতৃত্বের একাংশ।” এমনকী ওই কমিটি আগামী দিন কোনও কর্মসূচি গ্রহণ করলে তারও বিরোধিতা করা হবে বলেও নিলয়বাবু জানিয়ে দেন।
সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারি ফেডারেশনের রাজ্য স্তরের কমিটি এখন পর্যন্ত গঠন হয়নি। গত ২০১৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে ওই সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তিন জন আহ্বায়ক দিব্যেন্দু রায়, সৌম্য বিশ্বাস এবং তপন গড়াই-সহ ৪১ জনের কোর কমিটি গঠিত হয়। সিদ্ধান্ত হয় ছ’মাসের মধ্যে ওই সংগঠনের সম্মেলন হবে। রাজ্য সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে রাজ্য ও জেলা কমিটিগুলি গঠিত হবে। কিন্তু এখনও রাজ্য ও জেলা কমিটিগুলি গঠন হয়নি।
তা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি ওই সম্মেলন আয়োজনের মধ্যে দিয়েই সরকারি কর্মীদের কোন বার্তা দিতে চাইছে জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব? প্রশ্ন উঠেছে। উজ্জ্বলবাবু বলেন, “সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য হলো সরকারি সব প্রকল্প সার্থক রূপায়ণে সংগঠনের সদস্য সরকারি কর্মীরা একযোগে কাজ করবেন।” যদিও মঞ্চে বড় বড় করে উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি হিসেবে জেলা তৃণমূলের সভাপতি মান্নান হোসেন ও ইন্দ্রনীল সেনের নাম ছিল। কিন্তু মান্নানবাবু শারীরিক ভাবে অসুস্থ থাকার জন্য এবং গায়ক ইন্দ্রনীল বর্ধমানে মাটিতীর্থ উত্সবে ব্যস্ততার কারণে আসতে পারেননি।
২০১০ সালের ২৪ নভেম্বর বহরমপুর গ্রান্টহলে সংগঠনের পক্ষ থেকে এক কনভেনশনের আয়োজন করা হয়। ওই কনভেনশনে ৪১ জন সরকারি কর্মী উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে থেকে ১৭ জনের কমিটি গঠিত হয়। পরে ওই সংগঠনের মধ্যে বিভিন্ন উপদল তৈরি হয়। এর মধ্যে গত ১৩ অগস্ট তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক ইন্দ্রনীল সেনের পরামর্শে তৃণমূলের জেলা নেতা সুবোধ দাস ও সত্যেন চৌধুরী মধুপুরে দলীয় কার্যালয়ের দোতলায় ওই সংক্রান্ত ২৩ জনের কমিটি গড়ে দেন। ওই কমিটিতে মনোজ চক্রবর্তী-সহ পুরনো সদস্যদের পুনর্বহাল হয়। সেই সঙ্গে যারা উপ-দল তৈরি করেছিল, তাদেরও নাম ছিল বলে জানা গিয়েছে।
উজ্জ্বলবাবুর কথায়, “সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী তথা দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও দলীয় জেলা পর্যবেক্ষক ইন্দ্রনীলের সেনের নির্দেশে এবং মান্নান হোসেনের অনুপস্থিতিতে আমি ওই জেলা সম্মেলনে উপস্থিত ছিলাম। এদিন পুরনো সমস্ত কমিটি ভেঙে দিয়ে সকলের সঙ্গে আলোচনা করে প্রস্তাবিত নতুন কমিটির গড়া হয়েছে। রাজ্য নেতৃত্বের অনুমোদন পেলে ওই কমিটি পুরোদমে কাজ শুরু করবে।”
এ দিন যে নতুন কমিটি গঠিত হয়েছে, তাতে নতুন সভাপতি হন অশোক রায় এবং সহ-সভাপতি মানোয়ার আলি। মানোয়ার আলি বলেন, “আমাদের সংগঠনের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রয়েছে। সম্মেলন যাতে বানচাল করা যায়, তার জন্য দলেরই বিভিন্ন গোষ্ঠী অতি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। সম্মেলনের তারা বিরোধিতাও করে। সব প্রতিকূলতা জয় করে সম্মেলন সফল হয়েছে।”
নীলয়বাবু অবশ্য বলেন, “নতুন যে কমিটি গঠন হয়েছে, সম্মেলন শেষে ওই কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করার কথাও ছিল। কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিষেধ করার ফলে ওই কমিটির নাম ঘোষণা করা হয়নি। প্রস্তাবিত আকারে রাখা হয়েছে। রাজ্য নেতৃত্বের অনুমোদন পেলে তবেই ওই কমিটি ঘোষণা হবে। তবে ওই জেলা সম্মেলনকে ঘিরে সরকারি কর্মচারিদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এতে সাংগঠনিক ভাবে দলের ক্ষতি হবে।”
সব মিলিয়ে সরকারি কর্মচারি সংগঠন কাজ শুরুর আগেই তৃণমূলের অন্দরের কাজিয়া সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ্যে এসে পড়ায় ‘ব্যাকফুটে’ নতুন কমিটি। ফলে নতুন কমিটি কতটা স্বস্তিতে থাকবে, তা নিয়ে সরকারি কর্মীদের মধ্যেই গুঞ্জন উঠেছে।