অঘ্রানে এমন ঠান্ডার দাপট শেষ কোন বছরে পড়েছিল, তা নিয়ে হিসেব করতে করতেই বর্ষশেষ এসে হাজির। সঙ্গে কাঁপুনি ধরানো কড়া শীত। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর থেকেই বড়দিনের ছুটি শুরু। আর শীতের ছুটি মানেই স্বল্প দূরত্বের বেড়ানো। পর্যটকদের কাছে এ বার বড়দিনে ছোট ট্যুরের জন্য আদর্শ। নবদ্বীপ মায়াপুর বেথুয়াডহরিতে উপচে পড়া পর্যটকের ভিড়। পৌষের রোদে পিঠ দিয়ে গঙ্গা জলঙ্গির পাড়ে পিকনিক, ‘পয়লা কাটের’ নলেন গুড় কিংবা আসল দার্জিলিঙ লেবুর মায়াবি স্বাদ দুই-ই এবার নাগালের মধ্যে। গতবারের কুড়ি টাকা জোড়া কমলালেবু এবার ১৪ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হছে। পঞ্জাবের প্রমাণ সাইজের তিনটে লেবু ২০ টাকা। ফলের ব্যবসায়ীরা বলছেন এবার লেবুর প্রচুর ফলন। দাম নাকি আরও কমবে। সবে বাজারে আসছে নলেন গুড়, ৫০ থেকে ৭০ টাকা প্রতি কেজি।
ক্রিসমাস নয় কেকমাস
ডিসেম্বর পড়তেই শুরু হয়ে যায় কেকের মরসুম। ক্রিসমাস বা বর্ষশেষও নয়, মফস্সলের ব্যবসায়ীদের কাছে ইংরাজি বছরের শেষ মাসটি শুধুই কেক-পেস্ট্রিময়। এমনিতে রোজকার খাদ্যতালিকায় কেকের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। নবদ্বীপে বড়দিনের সময় নামী কোম্পানি ও বেকারি মিলিয়ে প্রায় কোটি টাকার ব্যবসা হয় এসময়। এমনটাই মনে করেন নবদ্বীপের দুই অন্যতম প্রধান কেক ব্যবসায়ী চন্দন দাস এবং অনুপ কুমার সাহা। তাঁদের কথায়, “প্রধানত স্থানীয় বেকারিরর কেক এবং নামী কোম্পানি এই দুই ধরনের কেকের উপরই দাঁড়িয়ে আছে কেক ব্যবসা। বেকারি কেকের বাজার প্রধানত গ্রামীণ ক্রেতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যদিও নামী কোম্পানির ছোট বড় নানা মাপের, নানা দামের কেক ছেয়ে ফেলছে গ্রামীণ বাজারও। ছোট হয়ে আসছে বেকারির পরিসর।
অনুপবাবু বলেন, “নবদ্বীপ অনেক তাবড় তাবড় শহরকে কেক ব্যবসায় লজ্জা দেবে। সারা বছর ধরে জন্মদিন থেকে বিয়ে নানা অনুষ্ঠানে কেকের বিপুল ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। শুধু ২৫ ডিসেম্বরেই বহু দোকান আছে যাদের বিক্রি ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। কলকাতা থেকে একশো কিলোমিটার দূরের একটা শহরে এই পরিমাণ ব্যবসা কিন্তু সহজ ব্যাপার নয়।”
কিন্তু এসব খুব বেশি দিনের কথা নয়। বড়দিনের কেক নিয়ে সাধারণ মানুষের এমন হুজুগ শুরু হয়েছে বড় জোর দশ-বারো বছর। বলছিলেন নবদ্বীপের প্রথম কেক ব্যবসায়ী প্রবীণ চন্দন দাস। তিনি বলেন, “প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা, সবে তখন দোকান করেছি, অল্প বয়েস, নিজে কলকাতা চষে বাছাই করে কেক আনলাম।”
কেকের দাম প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, কোম্পানির কেকের মধ্যে প্রধানত ফ্রুটকেক আর প্লামকেক এই সময়ে সব থেকে বেশি বিক্রি হয়। ফ্রুটকেকের মধ্যে সব থেকে কম দাম টিফিন কেকের। ৫ টাকা থেকে শুরু। তারপর ১০, ২০ এবং ৩০ টাকার স্লাইস কেক। পরের ধাপে শুরু ক্রিসমাস কেক, ৩৫০ গ্রাম থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের ওইসব কেকের দাম শুরু ৭০-৮০ টাকা থেকে। ওপরে ৭০০ টাকা। অনুপবাবু বলেন, “তবে এবারে কেকের দাম কিছুটা বেড়েছে।” তিনি বলেন, “গত বছর আমি ৬০০ টাকা পর্যন্ত দামের কেক বিক্রি করেছি। তবে এই ক’বছরের অভিজ্ঞতায় দেখছি দামি কেক সবার আগে শেষ হয়ে যায়।” বেকারির কেকও ৫৫-৬০ টাকা থেকে ১৫০- ২০০ টাকা দামের হয়।
মটরশুঁটির কচুরি, নলেন গুড়ের রসগোল্লা
নবদ্বীপের বিভিন্ন বৈষ্ণব মঠমন্দিরে আত্মবত্ সেবা প্রচলিত আছে। যার অর্থ হল, মানুষ নিজে খাওয়া পড়ায় যে ভাবে দৈনন্দিন জীবন যাপন করে, ঠিক সেই ভাবে ঈশ্বরকে নিত্য দিন পুজো করা। যে কারণে নবদ্বীপ মায়াপুরের কয়েকশো মঠ মন্দিরে দেবতার ভোগের উপকরণ, পদ ঋতু অনুসারে বদলে যায়। গরমের শুক্তো-সরবত-দই শীতে বদলে যায় খিচুড়ি-কচুরি-পায়েসে। কার্তিক মাস পড়তেই বদলে যায় মঠমন্দিরের ভোগের মেনু।
ভোর বেলায় মঙ্গলাভোগ, একটু বেলায় বাল্যভোগ, শৃঙ্গারভোগ, মধ্যাহ্নে রাজভোগ, বিকেলে বৈকালিভোগ রাতে শয়নারতির সময় শীতল ভোগ ইত্যাদি। ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের ভোগের কাঠামো যায় আমূল বদলে।
নবদ্বীপের জন্মস্থান আশ্রমের প্রধান তথা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস বলেন, “অঘ্রান পৌষ মাঘ, এই তিন মাস আমরা মঠ মন্দিরে দেবতাকে নিয়ম করে সকালের বাল্যভোগে খিচুড়ি দিয়ে থাকি। তেমনই রাত্রে কড়াইশুঁটির কচুরি সঙ্গে শীতকালীন সব্জি। নলেন গুড়ের পায়েস, সন্দেশ, রসগোল্লা এবং মরসুমি ফলমূল দেওয়া হয় বিকেল বা ভোরের মঙ্গলভোগে। আসলে ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক যেমন ভাবে আমাদের খাওয়া দাওয়ায় বদল ঘটে তেমন ভাবেই ভোগও বদলে যায়।
নবদ্বীপের ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরের প্রবীণ সেবাইত লক্ষ্মীনারায়ণ গোস্বামী বলেন, “গোটা শীতকাল জুড়ে নিয়মিত পিঠে পুলি পায়েস ভোগ দেওয়া হয় মহাপ্রভুকে। তার সঙ্গে তিথি মেনে পৌষপার্বণ, নবান্ন সবই হয়। ফলে শীতকাল মানেই একটু গুরপাক খাওয়া দাওয়া।”