আঁচ জুড়োচ্ছে। কমেছে উৎপাদন, বকেয়া মজুরি, পালাচ্ছেন শ্রমিকেরা। ধুবুলিয়ার রাজাপুরে একটি ইটভাটায় সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
নগদ টাকার অভাবে দেশের বেশির ভাগ জায়গায় বড় নির্মাণকাজ প্রায় বন্ধ। ইটের চাহিদা তলানিতে।
কারেন্ট অ্যাকাউন্টে সপ্তাহে ব্যাঙ্ক থেকে মাত্র ৫০ হাজার টাকা তোলা যাচ্ছে। তা দিয়ে ইটাভাটা শ্রমিকদের পুরো মজুরি মেটানো যাচ্ছে না। রোজ কাজও দেওয়া যাচ্ছে না।
ফলে যে নভেম্বর থেকে জুন মাস ইট ব্যবসার সেরা মরসুম, তখনই তা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে। ইটভাটা মালিকদের একটা বড় অংশের আশঙ্কা, এ ভাবে আর সপ্তাহ দুয়েক চললে অধিকাংশ ভাটাই বন্ধ হয়ে যাবে।
আশ্চর্যের কিছু নেই।
বিভিন্ন অংসগঠিত ক্ষেত্রের মতো ইটভাটা শ্রমিকেরাও আপাতত এখান সেখান থেকে ধার করে টাকার অভাব মেটাচ্ছেন। কিন্তু মুদি থেকে স্টেশনারি বা সব্জির দোকান, সকলেরই ধার দেওয়ার ক্ষমতা ক্রমে ফুরিয়ে আসছে। তা ছা়ড়া, ভাটা শ্রমিকদের একটা বড় অংশ পশ্চিমের জেলা বা রাজ্য থেকে আসা। মুখচেনা না হওয়ায় এলাকার দোকান তাঁদের ধার দিতে চাইছে না। অনেকেই এখনও মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেও কিছু-কিছু ইতিমধ্যে ভাটা ছাড়তে শুরু করেছেন।
মুর্শিদাবাদ জেলায় ৬৮৫টি ভাটা আছে, নদিয়ায় প্রায় চারশো। দুইয়ে মিলিয়ে অন্তত লাখ দেড়েক শ্রমিক কাজ করেন। কাউকে দৈনিক, কাউকে সাপ্তাহিক, কাউকে মাসিক মজুরি দেওয়া হয়। নভেম্বরের গোড়া থেকে পুরোদমে কাজও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ৮ নভেম্বর রাতে নোট বাতিলের ঘোষণা হওয়ার পরেই সব গোলমাল হয়ে গিয়েছে। এখন যে শ্রমিকদের শুধু পুরো পারিশ্রমিক দেওয়া যাচ্ছে না তা নয়, অনেককে কাজও দেওয়া যাচ্ছে না।
ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জে থেকে এক মাস আগে ধুবুলিয়ার রাজাপুরে একটি ইটভাটায় এসেছেন ইউসুফ আনসারি। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘মালিক সব সময় কাজ দিতে পারছেন না। গত দু’দিন আমি ও আমার চার ছেলে কোনও কাজ পাইনি।” ধুবুলিয়ার ন’পাড়ার দোস্ত মহম্মদও ওই ইটভাটায় কাজ করেন। তিনিও বলেন, “যেখানে সপ্তাহে দু’হাজার টাকা পেতাম, এখন বড় জোর পাঁচশো-হাজার পাচ্ছি।”
নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট ব্রিক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুনীল পাল বলেন, “মজুরি থেকে শুরু করে মাটি, কয়লা ও ডিজেলের দাম দিতে খুচরো টাকা লাগে। সপ্তাহে ৫০ হাজার টাকায় খরচ চালাতে সমস্যা হচ্ছে।” তাঁর হিসেবে, উৎপাদন প্রায় ২৫ শতাংশ কমে গিয়েছে।
মুর্শিদাবাদ ডিষ্ট্রিক্ট ব্রিক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মহম্মদ আইজুদ্দিন মণ্ডল জানান, ভাটা পিছু দেড়শো শ্রমিককে
গড়ে ৩০০ টাকা মজুরি দিতে হলে গত ১৫ দিনে এক-এক জনের পাওনা সাড়ে ৪ হাজার টাকা। কিন্তু খুচরো অমিল হওয়ায় তা বকেয়া পড়ে থাকছে। প্রয়োজন মতো মালিকের থেকে ১০০ -২০০ টাকা অনেকে কাজ চালাচ্ছেন। কিন্তু পুরনো নোট নিতে চাইছেন না।
লালবাগ নতুনগ্রামের মাহমুদ আলি বলেন, ‘‘আমাদের অনেকেরই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে। কিন্তু পুরনো পাঁচশো বা হাজারের নোট নিয়ে তা বদল করতেই যদি সারা দিন ব্যাঙ্কে লাইন দিতে হয়, কাজ করব কী করে? খাব কী?’’ নবদ্বীপের আনন্দবাসে ইটভাটা শ্রমিক, ভালুকার বাসিন্দা সুমিত্রা সর্দার, পার্বতী সর্দার, বাবলু সর্দারদের আক্ষেপ, “মজুরি চাইলেই মালিক বলছে, ব্যাঙ্ক টাকা দিচ্ছে না। আমাদের কী ভাবে চলবে?”
মুর্শিদাবাদের ইটভাটা মালিক সংগঠনের কার্যকরী কমিটির সদস্য আবদুল বাকি বলেন, ‘‘ইট লোকে নগদেই কেনে। ফলে বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে। মজুরি বা কাজ না পেয়ে না শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে পালানোয় সমস্যা আরও বাড়ছে। ’’
পালাচ্ছেন মূলত বাইরে থেকে আসা শ্রমিকেরা, ইটভাটায় যাঁদের সংখ্যা বিপুল। না পালিয়েই বা তাঁরা করবেন কী? বিহারের শওকত আলি বলেন, ‘‘ভাটায় পরিবার নিয়ে থাকি। কিন্তু এলাকার মানুষ আমাকে কেউ চেনে না। ফলে কেউ ধার-বাকি দিতে চাইছে না। সংসার চালাব কী করে! ভেবেছি, কয়েক দিন দেখে বিহারে ফিরে যাব।’’