প্রতীকী ছবি।
সরকার কাজের বরাত দেয় ঠিকাদার সংস্থাকে। আর ঠিকাদার সংস্থা কম পয়সায় অদক্ষ কর্মীদের বেশি কাজের ‘টার্গেট’ বেঁধে দেয়। আর তা পুরণের দৌড়ে ভোটার থেকে আধার বা খাদ্যসুরক্ষার কার্ডে উনজিলার স্বামীর নামের জায়গায় বসে যায় ডোমকল হাসপাতাল। মোস্তাকিন শেখের ঠিকানায় বাবলাবোনার বদলে বসে যায় বাংলাদেশ।
কিন্তু ঠিকাদার সংস্থা কাজ করলেও গোটা বিষয়টি তদারকির জন্য বিধানসভা ভিত্তিক ওই কাজ দেখার জন্য এক জন সরকারি আধিকারিকও থাকার কথা। প্রশ্ন উঠেছে এই ভুলে ভরা আধার-ভোটার কার্ডের পিছনে তাঁর কি কোনও ভূমিকাই নেই?
মহকুমা ও ব্লক আধিকারিকেরাও এ ব্যাপারে কাজের দেখভাল করেন। তা হলে নজরদারির এত স্তর থাকা সত্ত্বেও এমন উদ্ভট ভুল হয় কি করে? যে ভুল সংশোধন করতে রাত জেগে লাইন দিতে হয়অ সংখ্য মানুষকে!
ভোটার কার্ড তৈরির কাজ করতেন ডোমকলের মিজানুর রহমান। এখন কেরলে শ্রমিকের কাজ করেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতি ব্যক্তির ভোটার কার্ড তৈরির জন্য একটা নির্দিষ্ট টাকা বরাদ্দ করা হত। কাজ শেষ করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হত। তাই একটু বেশি পয়সা আর দ্রুত কাজ শেষ করতে গিয়ে ভুল থেকে যেত আমাদের।’’
মিজানুরকে ভোটার কার্ডের জন্য তথ্য নথিভুক্ত করার দায়িত্ব দিয়েছিল একটি বেসরকারি সংস্থা। এমন অনেক বেসরকারি সংস্থা সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের পরিচয়পত্র তৈরির বরাত পেয়ে থাকে। সেই সংস্থাগুলো কেন নজর রাখেনি তাদের কর্মীদের উপরে? মুর্শিদাবাদে এখন ভোটার কার্ড তৈরির কাজ করছে এমন একটি ঠিকাদার সংস্থা। জানা গিয়েছে, কখনও কার্ড প্রতি, কখনও দিন প্রতি কাজ করানো হয় সংস্থার কর্মীদের। কাজের সরকার নির্দিষ্ট পয়সা বরাদ্দ করে। ওই সংস্থার পক্ষে এক কর্তা বলেন, ‘‘ফলে আমাদেরও সেই পথেই হাঁটতে হয়। আর তা করতে গিয়ে কিছু ভুল থেকে যায়।’’ এমন আর একটি ঠিকাদার সংস্থার এক কর্তা অরূপ দত্ত বলছেন, ‘‘আদতে কী ভুল হয়েছে, বা কী কারণে হয়েছে, সেটা না দেখে বলা সম্ভব নয়।’’
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ঠিকাদার সংস্থাগুলো কর্মীদের নিয়োগ করার সময় যোগ্যতামান বেঁধে দিয়েছিল কি না। বিভিন্ন সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, তেমন কোনও যোগ্যতামান ছিল না। সরকার থেকেও বলে দেওয়া হয়নি। ঠিকাদার সংস্থাগুলো তাই মোটামুটি স্থানীয় যুবকদের মধ্যে যাঁরা কম্পিউটার জানেন এবং কিছুটা অন্তত পড়াশোনা করেছেন, তাঁদেরই বেছে নিয়েছিলেন। মিজানুরের মতো ওই যুবকেরা কার্ড পিছু টাকা পেতেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা কাজ ঠিক ভাবে করছেন কি না, সেই নজরদারিও তেমন ছিল না বলে অভিযোগ। অনেকেরই দাবি, পরিচয়পত্র নথিভুক্ত হওয়ার সময় সরকারি আধিকারিকদের দেখতে পাওয়া যেত না। সরকারি আধিকারিকেরা কোনও ঠিকাদার সংস্থাকে বরাত দিয়েই নিশ্চিন্ত হয়ে যেতেন। আর কার্ড তৈরির সময়ে তাই পুরুষের নামের পাশে মহিলার ছবি বা মহিলার জায়গায় পুরুষের, ২৫ বছরের যুবক মোজাম্মেল হকের বয়স ৭৫ আবার ৬২ বছরের নিখিল মজুমদার হয়ে গিয়েছে ৩২ বছরের যুবক। তাঁদের এখন সংশোধনের জন্য ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।
প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, অনেক আধিকারিকেরাই বদলে গিয়েছেন, তাই তাঁদের আমলে কী ভাবে কাজ হয়েছে, তা বলতে পারা যাচ্ছে না। তবে এখন জেলা প্রশাসন নতুন করে পরিচয়পত্র তৈরির যে কোনও কাজে প্রতিটি বিধানসভা এলাকার জন্য এক জন করে আধিকারিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্লক পিছুও এক জন করে আধিকারিককে কার্ড তৈরির কাজ দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাতে এ বার সুষ্ঠু ভাবেই নতুন পরিচয়পত্র তৈরি করা যাবে বলে তাঁদের দাবি। তবে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও যথেষ্ট ক্ষোভ।
রানিনগরে কংগ্রেস বিধায়ক ফিরোজা বেগম বলেছেন, ‘‘মানুষের নামে জুড়ে যাচ্ছে হাসপাতাল, এমন আজব ঘটনার একটা বিহিত হওয়া উচিত।’’
তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা মুর্শিদাবাদের সাংসদ আবু তাহের খানও বলছেন, ‘‘আমরাও বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনকে বলব, যাতে ওই কাজ নির্ভুল হয় ও সাধারণ মানুষের হয়রানি কমে।’’
তবে আদতে কতটা নির্ভুল হবে বা মানুষের হয়রানি কমবে তার নিয়ে মানুষের সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। যদিও মুর্শিদাবাদের জেলা শাসক জগদীশ প্রসাদ মিনা বলছেন, ‘‘আমরা আগেও ওই কাজে নজরদারি করতাম, তবে এখন সেই নজরদারি আরও বাড়ানো হবে। নির্ভুল করার চেষ্টা করার করতে যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেটাও করব আমরা।’’
সে সতর্কতা আগে করেননি কেন? না, তার কোনও উত্তর মেলেনি।