‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্পের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন মুর্শিদাবাদে

শুকিয়ে গিয়েছে নতুন কাটা পুকুরও

ঘটা করে জেলাজুড়ে নতুন পুকুর কাটা হয়েছিল। মজে যাওয়া পুকুরের সংস্কারও হয়েছিল। একশো দিনের প্রকল্পে পুকুর কাটার পোশাকি ‘জল ধরো, জল ভরো।’ কিন্তু ওই প্রকল্পে কাটা বেশিরভাগ পুকুরই জলশূন্য। ফলে প্রশ্ন উঠছে প্রকল্পের সার্থকতা নিয়ে। পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে জেলা পরিষদের সভাধিপতি মায় জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্তাও মানছেন ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্প কার্যত ব্যর্থ।

Advertisement

বিমান হাজরা

রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৫ ০১:৩০
Share:

এক ফোঁটা জলও নেই। সাগরদিঘির শেখদিঘিতে তোলা নিজস্ব চিত্র।

ঘটা করে জেলাজুড়ে নতুন পুকুর কাটা হয়েছিল। মজে যাওয়া পুকুরের সংস্কারও হয়েছিল। একশো দিনের প্রকল্পে পুকুর কাটার পোশাকি ‘জল ধরো, জল ভরো।’ কিন্তু ওই প্রকল্পে কাটা বেশিরভাগ পুকুরই জলশূন্য। ফলে প্রশ্ন উঠছে প্রকল্পের সার্থকতা নিয়ে। পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে জেলা পরিষদের সভাধিপতি মায় জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্তাও মানছেন ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্প কার্যত ব্যর্থ।

Advertisement

গত কয়েক’টি অর্থবর্ষে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে জেলার বিভিন্ন পঞ্চায়েত এলাকায় প্রচুর পুকুর কাটা হয়। উদ্দেশ্য, শুখা মরসুমে ওই জল ব্যবহার করা হবে সেচের কাজে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে সিংহভাগ পুকুরই জলশূন্য। জেলার একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানরা দাবি করছেন, পুকুরগুলিতে জল নেই। সাগরদিঘির মোরগ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কংগ্রেসের প্রশান্ত ঘোষ বলেন, ‘‘গত এক বছরে প্রায় ১৫টি মজে যাওয়া পুকুর খনন করা হয়েছে। সব পুকুরই ব্যক্তি মালিকানার। শর্ত ছিল, সেচ ও অন্যান্য কাজে ওই পুকুরের জল সকলেই ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু খরায় প্রায় সব পুকুরই শুকিয়ে কাঠ।’’

একই বক্তব্য সাগরদিঘির মনিগ্রামের পঞ্চায়েতের প্রধান সিপিএমের দেবাশিস সরকারের। তাঁর অভিজ্ঞতা, এক বছরে ১২টিরও বেশি পুকুর কাটানো হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টির পরিমাণ কমতেই সেগুলিতে জল নেই। এমনকী ভাগীরথীর সঙ্গে যুক্ত এলাকার বড় বড় জলাশয়গুলিও জলহীন। সেগুলির সংস্কার করলে এই মরসুমে জল মিলত। সামশেরগঞ্জের প্রতাপগঞ্জের প্রধান কংগ্রেসের নুরেজা বিবির কথায়, ‘‘পুকুরগুলির মধ্যে ২৫ শতাংশে কিছুটা জল আছে। তবে তা দিয়ে সেচ বা মাছ চাষ অসম্ভব। এই অবস্থায় ‘জল ধরো, জল ভরো’র সাফল্য মেলা সম্ভব কী করে?’’

Advertisement

কোটি কোটি টাকা খরচ করে ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলেই মনে করেন কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত জেলা পরিষদের সভাধিপতি শিলাদিত্য হালদার। তিনি এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের গাফিলতিকে দায়ী করে বলেন, ‘‘আর্সেনিকপ্রবণ জেলার প্রতিটি গ্রামে পুকুরের জলকে কাজে লাগিয়ে ছোট আকারে পরিশ্রুত পানীয় জল প্রকল্পের ব্যবস্থা করা যেত। সঙ্গে মাছের চাষ করে এলাকার আর্থিক হাল ফেরানোও সম্ভব হত। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। রাজ্য সরকার ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্প ঘোষণা করল। কিন্তু সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত করার জন্য কোনও নজরদারিই নেই। আবার অনেকক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে পুকুর কাটা হয়েছে স্রেফ খাতায় কলমে। জেলা পরিষদ বহু সেচ-নালা খনন করেছে। কিন্তু সেই সব ‘ক্যানেল’ জবরদখল হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছিল। তা মেলেনি।’’

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, মুর্শিদাবাদ জেলায় পুকুর ও বিল রয়েছে ৯৭৭৮.৩৪ একর। সবচেয়ে বেশি জলাশয় রয়েছে সুতি-১ ব্লকে। ১৪৯৩.৬৭ একর। জেলার অন্যান্য ব্লকেও জলাভূমির পরিমাণ কম নয়। ফরাক্কা ব্লকে জলাভূমি রয়েছে ৯০৩ একর। রঘুনাথগঞ্জ-১ ব্লকে জলাশয়ের পরিমান ৮১৭ একর ও বহরমপুরে ৭৫৪একর জলাভূমি রয়েছে।

জেলা সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে সুতি-১ ব্লকের বংশবাটি বিলটি নিয়ে একটি সমীক্ষা হয়। দেখা যায়, ৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার এই জলাশয়ের এক সময় সারা বছরের জলধারণ ক্ষমতা ছিল ২৩,৫০০ কিউমেক মিটার। বর্তমানে পলি জমে বিলটির আয়তন মারাত্মকভাবে কমেছে। এখন ওই বিলের জলধারণ ক্ষমতা বর্ষাকালে ২.৫০ কিউমেক মিটার। ১০০ দিনের প্রকল্পকে কাজে লাগিয়ে এই বিল খননের চেষ্টা হয়। কিন্তু শেষমেশ তা বাস্তবায়িত হয়নি।

এক সময় জেলা পরিষদের সহকারি সভাধিপতি ও সুতির বিধায়ক ছিলেন আরএসপির কৃষক সভার বর্তমান জেলা সম্পাদক জানে আলম মিঞা। তাঁর মত, জল ধরো, জল ভরো প্রকল্পকে সফল করতে হলে ওই বিলকে খনন করা দরকার। এই বিল ভাগীরথী, বাঁশলৈ ও পাগলা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। খনন করে বিলের জলধারণ ক্ষমতা বাড়ানো গেলে সেচ, পানীয় জল এবং মাছ চাষ করা যেত। একশো দিনের কাজে পুকুর কাটানোর নামে সরকারি টাকা হরির লুঠ হয়েছে। তৃণমূলের কিষাণ সেলের জেলা সভাপতি আব্দুল মতিন বলেন, ‘‘১০০ দিনের কাজে পুকুর খননের ব্যাপারে নজরদারি প্রয়োজন।’’ তাঁর কথায়, পুকুরে জল ধরে রাখতে পারলে মাছ চাষ, সেচের বন্দোবস্ত হয়। পুকুর পাড়ে সব্জি চাষ করে অনেকেই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন। কিন্তু পুকুর খনন ব্যাপারটাই ঠিক ভাবে হয়নি। ফলে রুখা মরসুমে পুকুরে জল নেই।

কিষাণ কংগ্রেসের জেলা সভাপতি কাজেম আলিও মনে করেেন, পুকুর কেটে তাতে বৃষ্টির জল ধরে রাখতে হবে। কিন্তু পুকুর কাটার কাজেই যদি গলদ থাকে, তবে তাতে জল ভরা যাবে কী করে? এমনিতেই বৃষ্টির পরিমাণ যথেষ্ট কমেছে। ফলে বহু পুকুর শুকিয়েছে। পুকুরের জলধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে বাড়তি জল খরার সময় ব্যবহারের পরিকল্পনা করা যেত।

জেলায় ১০০ দিনের কাজের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) এনাউর রহমান। তিনি বলেন, ‘‘খনন করে পুকুরের গভীরতা বাড়িয়ে সঞ্চিত জলকে কাজে লাগাতে পারলে এলাকার আর্থিক চিত্রটাই বদলে যাবে। এই কাজে সরকারি নজরদারি যে নেই তা নয়।’’ কিন্তু, কেন পুকুরে জল থাকল না? তাঁর মত, বৃষ্টি কম হওয়ায় অনেক ছোট পুকুর শুকিয়ে গিয়েছে। সেই কারণেই ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্পে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement