গুমানি দেওয়ান স্মৃতিমঞ্চ। নিজস্ব চিত্র
কবিয়ালের গ্রামে নেই একজনও কবিগান শিল্পী, নেই কবিয়াল গুমানি দেওয়ানের স্মৃতির নামগন্ধও।
বাম আমল থেকে কবিয়ালের জন্মভিটে জিনদিঘিতে লোকশিল্পীদের জন্য একটি চর্চা কেন্দ্র গড়ার উদ্যোগ শুরু হলেও তা আর হয়ে ওঠেনি। ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গিয়েছে কুড়ি বছর। তাই কবিয়ালের স্মৃতি রক্ষায় এগিয়ে এলেন তাঁর গ্রামেরই বাসিন্দারা। গ্রামেরই হাইস্কুলে এলাকার দানে তৈরি হল গুমানি দেওয়ান মুক্ত মঞ্চ।
সাগরদিঘির জিনদিঘি এক প্রত্যন্ত গ্রাম। গুমানি দেওয়ানের জন্ম ও মৃত্যু গ্রামেই। গ্রামের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই শেষ করেছিলেন বিদ্যালয়ের পাঠ। সেই ১০ বছরেই কবিগানের শুরু। সেই থেকে টানা ৮১ বছর, ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার শেষ ছ’মাস ছাড়া, কবিগানই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান।
তাঁর দোহার বা সঙ্গীদের সকলেই মারা গেছেন। জিনদিঘিতে এক জনই বেঁচে রয়েছেন অনিল মাল। বলছেন, “অবিভক্ত বাংলার এমন কোনও গ্রাম নেই যেখানে তিনি যাননি। এমন কোনও পালা নেই যা নিয়ে গান বাঁধেননি। হিন্দু, মুসলিম পালা গাইতে গিয়ে সেকি অশান্তি বীরভূমের এক গ্রামে? জাতিতে মুসলিম হয়েও কেন তিনি হিন্দুদের বড় করে পালা গাইলেন? রাগ মৌলবাদীদের।’’ উত্তর দিনাজপুরে গান গাইতে যাওয়ার পথে ঘোড়ার গাড়ি থেকে পড়ে চোট পান বাম পায়ে। সেই থেকে স্বাভাবিক ভাবে চলতে ও দাঁড়াতেও কষ্ট হত তাঁর। শেষ দিকে তাই সামনে টেবিলের উপর পা তুলে দিয়েই পালা গাইতেন।”
কিন্তু তারপর ? জিনদিঘি গ্রাম ও তার আশপাশের গ্রামে এক জনও কেউ কবিয়াল হয়ে ওঠেননি। এমনকি তার বংশেরও কেউ বেছে নেননি কবিগানকে।
একমাত্র ছেলে আগেই মারা গিয়েছেন। বছর চুরাশি বয়সের এক মাত্র কন্যা লতা দেওয়ানের কথায়, “বাবা চাননি তাঁর পরিবারের কেউ আর কবিগান করুক। আমার ছেলে শুকুল দেওয়ান খুব ছোট বয়সে বাবার সঙ্গে গিয়েছিল কয়েকটি আসরে। বাবাই শেষ পর্যন্ত তাকে আটকে দেন।” বাবা কেন চাননি তাঁর বংশের কেউ কবিয়াল হয়ে উঠুক সে রহস্য আজও বুঝে উঠতে পারেননি তিনি।
স্কুলের ডিগ্রি না থাকলেও অবসর সময়ে বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্র, মনিষীদের জীবন কথার বইতে মুখ গুঁজে থাকতেন। বাড়িতে প্রতিবছর সরস্বতী পুজো হত ধুমধাম করে।
কুড়ি বছরে পড়ল জিনদিঘির রাজ্য কবিয়াল মেলা। কবিয়াল গুমানি দেওয়ানের স্মরণে বাম জমানায় শুরু হয়েছিল এই মেলা। রাজ্য কবিয়াল মেলা শুরুর পিছনে লক্ষ্য ছিল এই গ্রামেই একটি পূর্বাঞ্চলীয় লোক সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র স্থাপন। ২০০৬ সালে চর্চা কেন্দ্র গড়তে গুমানি দেওয়ানের পরিবারের দান করা ২৫ শতক জমির উপর ঘটা করে তার শিলান্যাসও করা হয়। কিন্তু বিবর্ণ ওই শিলা ফলকের চত্বর এখন গ্রামের গোচারণ ভূমি ছাড়া কিছু নয়।
না বাম সরকার, না বর্তমান সরকার কোনও আমলেই গুরুত্ব পায়নি চর্চা কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি।
কবিয়াল গুমানি দেওয়ানকে নিয়ে অজস্র স্মৃতি জড়িয়ে আছে গোটা রাজ্য জুড়েই। শুধু গলা ছেড়ে কবিগান গেয়েই আসর মাতিয়েছেন তাই নয়, তাঁর রচিত বহু সৃষ্টি সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গিয়েছে অযত্নে, অবহেলায়। সেই সব সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা ও চর্চার জন্যই গড়ে উঠুক পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র— এমনটাই থিম ছিল রাজ্য কবিয়াল মেলার প্রতিষ্ঠাতা বাম সাংস্কৃতিক নেতা মোজাফফর হোসেনের। তার আক্ষেপ, “তা হয়নি। ভিতরে ও বাইরে চারিদিক থেকে বাধার কারণে। এখন মেলাটা হয় বটে, তবে লোকসংস্কৃতির চর্চাভূমি আজও হয়ে উঠতে পারেনি জিনদিঘি।”