মাচা বিনে সীমান্তের গ্রামে প্রাণ আনচান

এক মাচায় পৃথক ফল! সীমান্তঘেঁষা ডোমকলে মাচাগুলো খাঁ খাঁ করছে। জোর গলায় সেই আড্ডা-তক্ক সব যেন ম্যাজিকের মতো উবে গিয়েছে। সৌজন্যে ভোট! অথচ পড়শি জেলার করিমপুর ও লাগোয়া এলাকার মাচাগুলিতে উল্টো ছবি। বৈশাখের বিকেলে ছায়া সুনিবিড় মাচায় গুছিয়ে বসে দিব্যি চলছে হইহই। বরং সেই ঝাঁঝ যেন আগের থেকে অনেকটাই বেশি।

Advertisement

সুজাউদ্দিন ও সামসুদ্দিন বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:০৫
Share:

কী ব্যাপার, এখানে ভিড় কেন? মাচায় খোঁজ নিচ্ছে আধাসেনা। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

এক মাচায় পৃথক ফল!

Advertisement

সীমান্তঘেঁষা ডোমকলে মাচাগুলো খাঁ খাঁ করছে। জোর গলায় সেই আড্ডা-তক্ক সব যেন ম্যাজিকের মতো উবে গিয়েছে। সৌজন্যে ভোট!

অথচ পড়শি জেলার করিমপুর ও লাগোয়া এলাকার মাচাগুলিতে উল্টো ছবি। বৈশাখের বিকেলে ছায়া সুনিবিড় মাচায় গুছিয়ে বসে দিব্যি চলছে হইহই। বরং সেই ঝাঁঝ যেন আগের থেকে অনেকটাই বেশি। কেন? সৌজন্যে সেই ভোট!

Advertisement

নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলিতে মাচা-সংস্কৃতি দীর্ঘ দিনের। সারাদিনের কাজকর্ম শেষে ওই এক ফালি বসার জায়গা যেন দখিনা বাতাস। অথচ ভোটের গুঁতোয় ডোমকলের সেই মাচাগুলি এখন আধাসেনা ও প্রশাসনের কড়া নজরে। তাদের সাফ কথা, এই মাচাই যত গণ্ডগোলের মূলে। ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাচা নিয়ে কোনও মাতামাতি নয়। যার নিট ফল মাচা আছে। কিন্তু মাচাপ্রেমীদের দেখা নেই!

অথচ বেশ কিছুদিন আগেও ডোমকল এলাকায় চিত্রটা ছিল অন্য রকম। সকাল সকাল কাজ থেকে ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে লোকজন ছুটতেন পাড়ার মাচায়। সেই মাচা প্রীতির বহর দেখে গিন্নিও বলেছেন—‘উফ্, ওই এক হয়েছে। মাচায় না বসলে বাবুর যেন ভাত হজম হয় না। দিনরাত মুখে বাঘ মারা ছাড়া যেন আর কোনও কাজ নেই!’ কথাটা কিন্তু একেবারে মিথ্যেও নয়। সম্পন্ন চাষি থেকে বেকার যুবক, স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে এলাকার গৃহশিক্ষক সকলে মিলে সে যেন লাইভ টিভি শো।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় আড্ডার বিষয়। ভোটের কিছুদিন আগে থেকে মাচায় ভিড় যেমন বাড়ছিল, তেমনি সংযোজন হচ্ছিল নিত্য নতুন বিষয়। জোট নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষের মতের বহর দেখলে মনে হত, এই বুঝি হাতাহাতি শুরু হল। কিন্তু ওই পর্যন্তই! সেই মনে হওয়ার মুখে ছাই ঢেলে একসঙ্গে চা-বিড়ি খেয়ে বাড়ি ফিরতেন সকলে।

তারপরে এল নারদ। ডোমকলের মাচার ঠিক পাশেই চায়ের দোকান আব্দুল গনির। তাঁর কথায়, ‘‘টিভিতে আর নারদ নিয়ে কী দেখাত! আসল নারদ-নারদ তো চলত এই মাচাতেই। আড্ডার মেজাজে শুরু হত আলোচনা। তারপর গলা চড়ত। তর্ক চলতে চলতে কত দিন যে গণ্ডগোল বেধে যেত। এই শর্মাকেই তখন হাল ধরতে হত! এখন অবশ্য সব চুপ মেরে গিয়েছে। লোকজনই তো আসে না। তর্ক কে করবে?’’

মাচায় যেতে না পেরে খারাপ লাগছে না? ভরদুপুরে খেত থেকে বাড়ি ফিরছিলেন তাহের শেখ। আমবাগানের ছায়ায় ফাঁকাই পড়েছিল মাচাটি। সে দিকে একবার তিনি তাকালেন বটে। কিন্তু এগোলেন না। দূরে একটি আমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাহের পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘‘এটা কি কোনও কথা হল কর্তা?’’

মলিন গামছাটা দিয়ে ঘাম মুছে ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, ‘‘জল ছাড়া মাছ আর মাচা ছাড়া আমাদের মতো মানুষ, দুই-ই সমান। এই গাঁ-গঞ্জে একটু গল্পগুজব ছাড়া আর কী আছে বলুন তো! সেই কারণেই মাচায় বসা। দু’চারটে লোকজনের সঙ্গে দেখা হয়। আড্ডা হয়। তর্ক হয়। কিন্তু ওই পর্যন্ত। বিশ্বাস করুন, কোনও গণ্ডগোল হয় না। অথচ প্রশাসনের লোকজন আধাসেনাদের নিয়ে এসে ফতোয়া দিয়ে গেল—‘মাচায় বসা চলবে না।’ এখন সময় যেন কাটতেই চাইছে না।’’

সে দিনের কথা এখনও স্পষ্ট মনে মজিবর শেখের। তিনি জানান, সে দিন জোট নিয়ে তর্ক জমে উঠেছিল। গরম সেই আলোচনায় জল ঢেলে দিয়েছিল আধাসেনার ভারি বুটের শব্দ। সঙ্গে ছিল পুলিশের লোকজনও। গম্ভীর গলায় তাঁরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ঢের গল্প হয়েছে। এ বার বাড়ি চলে যান। ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন মাচায় কাউকে না দেখা যায়।’ পুলিশে ছুঁলে রক্ষে নেই, তার উপরে আধাসেনা! ফলে কথা না বাড়িয়ে মানে মানে বাড়ির পথ ধরেছিলেন সকলেই।

জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, ‘‘ভোটের সময় এই মাচাগুলি থেকেও অনেক সমস্যা হয়। বড়সড় গণ্ডগোলের আশঙ্কা থাকে। সেই কারণেই এমন পদক্ষেপ।’’ যা শুনে কুপিলার এক মাচাপ্রেমী ফুঁসে উঠছেন, ‘‘এ তো দেখছি, যত দোষ মাচার ঘাড়ে। মাচা ছাড়াও এ তল্লাটে অনেক গণ্ডগোলের জায়গা আছে পুলিশ-প্রশাসন সেখানে নজর দিলে অনেকেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।’’

ডোমকলের আবু হায়াত বিশ্বাস বলছেন, ‘‘গ্রামের মাচায় আড্ডা বন্ধ থাকায় একটু খারাপ লাগছে ঠিকই। তবে নির্বাচনের সময় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিয়েছি।’’ যদিও গ্রামবাসীদের দাবি, মাছ, ভাত আর মাচা নিয়েই তো বাঙালি। অবাঙালি ওই আধাসেনারা আর মাচার মর্ম কী বুঝবে!

এ দিকে ডোমকলের মাচাগুলির এমন দশা দেখে সেখানকার বন্ধু ও পরিচিতদের ফোন করে টিপ্পনি কাটছেন জয়রামপুরের আলিম শেখ, গোপালপুরঘাটের বিশ্বজিৎ সাহারা। নদিয়ার এ তল্লাটে আবার উল্টো চিত্র। সময়ের সঙ্গে মাচাগুলোর শ্রী বেড়েছে। বাঁশের বাঁখারি ছেড়ে মাচা এখন সিমেন্টে মোড়া। সকাল-দুপুর-বিকেল আড্ডারও বিরাম নেই। হাসতে হাসতে আলিম, বিশ্বজিৎ বলছেন, ‘‘ফোনে ডোমকলের বন্ধুদের বলেছি, সময় পেলে আমাদের এখানে এসে আড্ডা দিয়ে যেতে। ভোট আসবে। ভোট যাবে। কিন্তু আড্ডা না থাকলে চলে না কি!’’

অতএব নির্বাচনের রাঙা চোখ উপেক্ষা করে আড্ডা কিন্তু চলছেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement