ফাইল চিত্র।
বড়দিনের সকাল সাড়ে ১০টা। হোটেলের সামনের রাস্তায় উপচে পড়া জনস্রোত দেখে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছিলেন প্রদীপ দেবনাথ। ধরা গলায় বলছিলেন, “সেই ফেব্রুয়ারির পর এই প্রথম মায়াপুর তার নিজস্ব চেহারায় ফিরল। দোলের সময় থেকেই মায়াপুরে লোকজন আসা কমে গিয়েছিল। লকডাউন ঘোষণার পর জনশূন্য রাস্তার ধারে নিজের খাঁ খাঁ হোটেলটা দেখতাম আর মনে হতো আর কোনও দিনই বোধহয় মানুষ আসবে না এখানে। কিন্তু শুক্রবার বড়দিনে যে ভাবে পর্যটকের এসেছে তাতে আমরা খুশি।”
খুশি হওয়ারই কথা। বড়দিনের মায়াপুরে কার্যত যাবতীয় প্রত্যশাকে ছাপিয়ে গিয়েছে মানুষের ভিড়। সব কিছু সেই আগের মতো। থাকার ঘর নিয়ে হাহাকার। নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইস্কনে যাবতীয় ‘বুকিং ফুল’। বড়দিনে বহু মানুষ প্রসাদের কুপন চেয়েও পেলেন না। নবদ্বীপ, স্বরূপগঞ্জের দিক থেকে একটা করে নৌকা, লঞ্চ মায়াপুরের ঘাটে ভিড়েছে আর বাঁধনহারা পর্যটকের দল তা নেমেছেন। বেলা যত বেড়েছে ভিড়ের ঘনত্ব ততই থিকথিকে হয়েছে। জনতার ভিড়ে কোথায় ভেসে গিয়েছে শারীরিক দূরত্বের বিধিনিষেধ। এ দিন মায়াপুরে আসা পর্যটকদের অনেকের মুখেই মাস্ক ছিল না। লম্বা সময় ধরে ঘিরে থাকা অতিমারির আতঙ্ক ভুলে বহু দিন পর মায়াপুর মেতে উঠেছিল বড়দিনের উৎসবে।
তবে এমনটা যে হতে পারে তা ডিসেম্বরের শনি-রবিবারগুলোর জনসমাগম দেখে খানিকটা আঁচ করছিলেন মায়াপুরের ইস্কন কর্তৃপক্ষ। সেই মতো বড়দিন থেকে শুরু করে নিউইয়ার পর্যন্ত সপ্তাহ কালের জন্য নানা ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। তবে শুক্রবারের ভিড় তাঁদের সেই প্রত্যশাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। এই প্রসঙ্গে ইস্কনের জনসংযোগ আধিকারিক রসিকগৌরাঙ্গ দাস বলেন, “শুক্রবার বিকেল তিনটে পর্যন্ত মায়াপুরে চল্লিশ হাজারের ওপর মানুষ এসেছেন। এর পর বিকেল ও সন্ধ্যায় আর একদফা ভিড় হবে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সপ্তাহের শেষে পনেরো থেকে আঠারো হাজার মানুষ গড়ে আসছিলেন। সেটা বড়দিনে পঞ্চাশ ছুঁয়ে ফেলবে।”
ফলে চিরাচরিত ঠাঁই নাই রব মায়াপুরে। ইস্কন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব প্রায় দশটি অতিথিশালা আছে। তাতে চার হাজার লোকের রাতে থাকার সুযোগ আছে। লকডাউন পরবর্তী সময়ে এই প্রথম সমস্ত গেস্টহাউস পর্যটকে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।
রসিকগৌরাঙ্গ দাসের কথায়, “এই করোনা কালে আমাদের দু’টি অথিথিশালা এখনও বুকিং নেওয়া হচ্ছে না। এগুলির একটি এখনও আমরা নিভৃতবাস হিসাবে ব্যবহার করছি। যারা অন্য জায়গা থেকে আসছেন তাঁদের চোদ্দো দিন ওখানে থাকতে হচ্ছে। আবার একশ টাকা ভাড়ার ডরমেটরিও ভাড়া দেওয়া হচ্ছে না। শ পাঁচেক মানুষ ওই দুই অথিতিশালা থাকতে পারতেন। বাকিগুলি আগামী ২ জানুয়ারি পর্যন্ত বুকিং হয়ে আছে। নতুন বুকিং ৪ জানুয়ারির আগে নেওয়ার উপায় নেই।” এ দিন ইস্কনে প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ দুপুরে প্রসাদ খেয়েছেন। না পেয়ে ফিরেছেন প্রায় সম সংখ্যক মানুষ।
মায়াপুর হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক প্রদীপ দেবনাথ বলেন, “প্রায় দশ মাস পর ডিসেম্বরের শেষে এসে ফের পর্যটকের ঢল নামল মায়াপুরে। এ বার কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করছি। সেই লকডাউন থেকে কী ভাবে চালাচ্ছি তা কেবল আমরাই জানি। তাই এখন উৎসবে মরশুম হলেও হোটেলের ঘরভাড়া বৃদ্ধি হয়নি। স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। যাতে মানুষ এসে ফিরে না যান।”
নবদ্বীপ জলপথ পরিবহণ সমবায় সমিতির সম্পাদক অলোক মণ্ডল বলেন, “ মায়াপুরের পর্যটকদের একটা অংশ নবদ্বীপ হয়ে যান। অন্যান্য বছরের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। তবে যে ভাবে চলছিল তার থেকে এ দিন যাত্রী সংখ্যা মোটের ওপর খারাপ হয়নি।”
সব মিলিয়ে জিশুর হাত ধরে বছরশেষে ফের চেনা ছন্দে নবদ্বীপ মায়াপুর।