রবীন্দ্রভবনে দলের কর্মিসভা ডেকেছেন দুই জেলা সভাপতি। হাজির হয়েছেন দলের সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে বিধায়ক ও নানা স্তরের নেতাকর্মীরা। হাজির জেলা পরিষদের সদস্যেরাও। সভা তখনও শুরু হয়নি। বাইরে ভিড়ের মধ্যে মুখোমুখি দেখা জেলা পরিষদের দুই কর্মাধ্যক্ষ। এক জন জিজ্ঞাসা করলেন, “কখন এলে?” চোখ টিপে উত্তর দেন অন্য জন, “গেলাম কখন, যে আসব? কেন তোমার যাওয়ার অফার আছে নাকি?” সঙ্গে সঙ্গে অন্য জন সিরিয়াস, “পরিস্থিতি ভাল না। এখন এ সব নিয়ে আড্ডা মেরো না। কে কী ভাবে নেবে, তার ঠিক নেই।”
লোকসভা নির্বাচনের পরে মুকুল রায়ের হাত ধরে রাজ্যের নানা প্রান্তের তৃণমূল নেতা-বিধায়কেরা বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। শোনা যাচ্ছে, সেই তালিকায় নাকি আরও অনেকের নাম আছে। রবিবারও মুকুল রায় দাবি করেছেন, তৃণমূলের বিপুল পরিমাণ নেতাকর্মী নাকি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন। বৃহস্পতিবার রানাঘাটে তৃণমূলের এক প্রাক্তন ব্লক সভাপতি এবং এক জেলা পরিষদ সদস্য-সহ কয়েক জন বিজেপিতে যোগ দেন। বেশ কিছু দলবদল করতে চলেছেন বলে জানাজানি হওয়ার পরে ধুন্ধুমার হয় চাপড়ায়। ফলে তৃণমূলে ভাঙনের আশঙ্কা এখন আর অলীক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, নদিয়া জেলাকে এক সময়ে মুকুল রায়ের ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ বলা হত। দীর্ঘদিন তিনি এই জেলায় তৃণমূলের পর্য়বেক্ষক ছিলেন। লোকে বলে, নদিয়া মুকুলের হাতের তালুর মতো চেনা। পুরনো দলের প্রত্যন্ত গ্রামের কর্মীদেরও তিনি চেনেন হাতের তালুর মতো। শুধু গ্রাম পঞ্চায়েত নয়, পঞ্চায়েত সমিতি থেকে শুরু করে জেলা পরিষদের সদস্য এমনকি মন্ত্রী- বিধায়কদের মধ্যেও অনেকে আছেন যাঁরা এক কালে ‘মুকুল রায়ের লোক’ বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে আলাদা গুরুত্ব আদায় করে নিতেন। দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার পরেও তাদের অনেকের সঙ্গেই যে মুকুলের যোগাযোগ ছিল তা বিলক্ষণ জানেন প্রায় সকলেই।
তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার এই হিড়িকের মধ্যে তাই সেই নামগুলো নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে আলোচনা হতে শুরু করেছে। তাঁদের নিয়ে সাধারণ কর্মীদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে কৌতূহল। ছড়িয়েছে রটনাও। শান্তিপুরের বিধায়ক, কংগ্রেস থেকে আসা অরিন্দম ভট্টাচার্যের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কথা সংবাদমাধ্যমের একাংশের কল্যাণে রটে যাওয়ার পরে সেটা আরও বেড়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শুধু কর্মীরাই নন, দলের বিভিন্ন নেতা-জনপ্রতিনিধিরাও জানতে চাইছেন, “আমাদের জেলায় কোনও উইকেট পড়ার খবর আছে নাকি?” কিংবা “অমুক বিধায়কের সঙ্গে নাকি মুকুলের কথা হয়েছে?” শুনে কেউ বলছেন, “মন্ত্রিত্ব ফেলে যাবে না। এত বোকা ও নয়!”
কোথাও গম্ভীর আলোচনা, আবার কোথাও নেহাত খিল্লি চলছে। গত বৃহস্পতিবার রবীন্দ্রভবনের সামনে দলীয় কর্মী বৈঠক শুরুর আগে দেখা গিয়েছে এমনই সব কাণ্ড। জেলার এক বিধায়ক তো এক জেলা পরিষদের সদস্যের সঙ্গে মজা করতে গিয়ে পিছিয়েই এলেন, “না বাবা, এখন মজা করা যাবে না। কে কী ভাবে নিয়ে বসবে, কে জানে।”
বোঝাই যায়, বিষয়টা আর নেহাত মজার মধ্যে নেই। একটা হালকা অবিশ্বাসের পরিবেশ যেন ছড়িয়ে পড়ছে দলের ভিতরে। সে কথা স্বীকারও করে নিচ্ছেন নেতারা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বৃহস্পতিবার কর্মিসভা শেষে রানাঘাট সাংগঠনিক জেলা সভাপতি শঙ্কর সিংহের পাশে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করে অরিন্দম ভট্টাচার্যকে দিল্লি যাওয়ার সাফাই দিতে হয়েছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে, বিজেপি শিবির থেকে তৃণমূলের নানা নেতা-জনপ্রতিনিধির নাম হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়ায়। যার জেরে প্রায় কেউই কাউকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না। যে কারণে মুকুল রায়ের নাম না করেও শঙ্কর সিংহকে বলতে হচ্ছে, “এটা রাজনীতির একটা কৌশল বলতে পারেন— অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। সেটাই ওঁরা করতে চাইছেন। কিন্তু সফল হবেন না।”