BTS

বেলডাঙা থেকে সিওল, বাড়ি থেকে পালিয়ে স্বপ্নের নায়কদের খোঁজ! ‘কুলীন’ হতে চেয়ে বিপদে খুদেরা

‘ব্যাংটন সোনিয়েন্ডন’, সংক্ষেপে ‘বিটিএস’ বলেই পরিচিত। শিল্পীদের নিখুঁত নাচ আর চোখধাঁধানো প্রযোজনা উঠতি প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মন কেড়ে আসছে গত প্রায় এক দশক ধরে।

Advertisement

প্রণয় ঘোষ

বহরমপুর শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৭:১৩
Share:

দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘ব্যাংটন সোনিয়েন্ডন’ সংক্ষেপে ‘বিটিএস’ বলেই পরিচিত। —ফাইল চিত্র।

কোথায় মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা, আর কোথায় দক্ষিণ কোরিয়ার সিওল! কলকাতা থেকে উড়ানপথে দূরত্ব চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। সেই দক্ষিণ কোরিয়ারই একটি জনপ্রিয় ব্যান্ড এতটাই জাঁকিয়ে বসেছে এ রাজ্যের ছেলেমেয়েদের মনে যে, তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে চাইছে সিওল। সম্প্রতি সপ্তম শ্রেণির তিন ছাত্রীকে হাওড়ার শালিমার থেকে উদ্ধারও করেছে পুলিশ। তিন জনেরই বাড়ি বেলডাঙায়। তদন্তে নেমে পুলিশ যে সব তথ্য জানতে পেরেছে, তাতে এই ব্যান্ড-প্রীতি যে কিছু পড়ুয়ার জীবনে ‘খ্যাপামি’র পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে, তা মানছেন তদন্তকারীরাও। তাঁদের আশঙ্কা বাড়ি থেকে পালিয়ে এই নাবালিকারা মাদক বা নারী পাচারের শিকার না হয়ে পড়ে! কেউ ভালবেসে ওই ব্যান্ডের গান শুনছে। তাদের নকল করতে চাইছে। পৌঁছতে চাইছে ব্যান্ড-তারকাদের কাছে। কেউ আবার সহপাঠী বা বন্ধুদের কাছে যাতে পিছিয়ে পড়তে না-হয় সেই কারণেই ‘কুলীন’ হতে চাইছে। দুয়ের যে কারণেই হোক না কেন, সমস্যা একই রকমের গুরুতর বলেই মানছেন পুলিশকর্তারা।

Advertisement

যে তিন নাবালিকাকে উদ্ধার করেছে পুলিশ, তাদের তিন জনের ক্ষেত্রেই কয়েকটা বিষয় একই ধরনের। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, তিন জনের মোবাইলেই ‘প্লে-লিস্ট’ জুড়ে কোরীয় পপ গানের লম্বা তালিকা। সেখানে রয়েছে ‘ফেক লভ’, ‘পারমিশন টু ডান্স’, ‘ফায়ার’— যে সব গান একাকিত্বের কথা বলে। আবার মনের জোরে তা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর গানও রয়েছে সেখানে— ‘আই নো হোয়াট আই অ্যাম/ আই নো হোয়াট আই ওয়ান্ট/...ইউ কান্ট স্টপ মি লভিং মাইসেল্‌ফ’ (আমি জানি আমি কী/ আমি জামি আমি কী চাই/… তুমি আমাকে নিজেকে ভালবাসতে থামাতে পারবে না)। তিন জনেরই জলের মতো মুখস্থ এই সব গানের কথা। তাদের ঘরের দেওয়াল জুড়েও রয়েছে ওই সঙ্গীতশিল্পীদের ছবি। গোলাপি-সাদা-সবুজ চুল, হালকা মেক-আপ, গলায় হার, কানে দুল, হাই-ফ্যাশন্‌ড জুতো পরা একদল মিষ্টি ছেলে, যারা ‘ব্যাংটন সোনিয়েন্ডন’, সংক্ষেপে ‘বিটিএস’ বলেই পরিচিত। শিল্পীদের নিখুঁত নাচ আর চোখধাঁধানো প্রযোজনা উঠতি প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মন কেড়ে আসছে গত প্রায় এক দশক ধরে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার এই জনপ্রিয় ব্যান্ড-প্রীতি যে এমন ‘খ্যাপামি’র পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, কল্পনাও করতে পারেননি তদন্তকারীরা। সব খোলসা হওয়ার পর এক তদন্তকারী অফিসারের মন্তব্য, ‘‘পাগলামি নয়তো কী! ১২-১৩ বছরের বাচ্চা মেয়ে। শুধু গান শুনতে বেলডাঙা থেকে সিওল যাওয়ার কথা ভাবতে পারে!’’

সম্প্রতি তিন নাবালিকা বেলডাঙা ‘পালানো’র পর মুর্শিদাবাদ পুলিশ রাজ্যের প্রতিটি থানাকে সতর্ক করেছিল। সেই সূত্র ধরেই অভিযান চালিয়ে শালিমার স্টেশন থেকে ওই তিন নাবালিকাকে উদ্ধার করে জিআরপি ও সাঁতরাগাছি থানার পুলিশ। তাদের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছিল, তিন নাবালিকাকে মুম্বইয়ে নিয়ে গিয়ে গান গাওয়া ও অভিনেত্রী হওয়ার প্রলোভন দিয়েছিলেন কেউ। পরে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, সে সব কিছুই না! বিটিএস-এর টানে স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন তিন নাবালিকা। তাদের গন্তব্য ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল! জিজ্ঞাসাবাদে যা উঠে এসেছে, তাতে কার্যত উদ্বিগ্ন পুলিশ প্রশাসন। আশঙ্কা, কিশোর-কিশোরীদের এই আসক্তি কাজে লাগিয়ে সক্রিয় হতে পারে মাদক এবং নারী পাচার চক্র। মুর্শিদাবাদ পুলিশ জেলার অতিরিক্ত সুপার (সদর) সুবিমল পাল বলেন, ‘‘তিন কিশোরী নিখোঁজের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি, তারা দক্ষিণ কোরিয়ার বিটিএস ব্যান্ডের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। ছেলেমেয়েদের এই দুর্বলতার সুযোগে কোনও পাচার চক্র সক্রিয় হচ্ছে কি না, সে দিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি আছে।’’

Advertisement

তিন নাবালিকার নিখোঁজের তদন্ত করতে গিয়ে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, ইউটিউবে কোরীয় পপ তারকাদের শুধু গানবাজনা, তাঁদের জীবনযাপন, সাজগোজ, পোশাকআশাক— সবই নকল করার প্রবণতা বাড়ছে শহুরে অল্পবয়সিদের মধ্যে। স্কুলে স্কুলে, বিশেষত ইংরেজি মাধ্যমগুলিতে তৈরি হচ্ছে ‘বিটিএস ফ্যান ক্লাব’। কিন্তু যারা এই স্রোতে গা ভাসাতে পারছে না, তারা নাকি ক্রমশ একঘরে হয়ে পড়ছে স্কুল, টিউশনে। খোঁজখবর করতে গিয়ে তদন্তকারীরা আরও জানতে পেরেছেন, এই উন্মাদনা এখন আর শুধু শহরাঞ্চলেই আটকে নেই, তা দ্রুত মফস্‌সলের স্কুলগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ছে। বেলডাঙার একটি নামী বেসরকারি স্কুলের এক ছাত্রের কথায়, ‘‘শুরুতে বিটিএস নিয়ে কিছুই জানতাম না। আগ্রহও ছিল না। পরে দেখলাম, স্কুলে কেমন যেন কোণঠাসা হয়ে পড়ছি। এটা কার ভাল লাগে! এখন আমিও দেখি বিটিএসের নাচগান। আমার স্কুলে ফ্যানক্লাবও রয়েছে।’’

তদন্তকারীদের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, তা হলে কি বিটিএসের স্রোতে ভেসে ‘কুলীন’ হতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকেই তিন নাবালিকা দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিল? অন্তত তিন জনের সুদূর সিওলে যাওয়ার গোটা পরিকল্পনা শুনে তেমনটাই মত পুলিশকর্তাদের একাংশের। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, ‘‘তিন জন প্রথমে মুর্শিদাবাদ থেকে ট্রেন ধরে কলকাতায় পৌঁছয়। সেখানে সল্টলেকের একটি জায়গায় তিন দিন আত্মগোপন করে ছিল ওরা। মোবাইল ছিল ওদের সঙ্গে। সেই মোবাইল ব্যবহার করেই শালিমার থেকে ট্রেনে মুম্বই যাওয়ার টিকিট কাটে ওরা। পরিকল্পনা ছিল— মুম্বই থেকে বিমানে করে সিওল। এই বয়সেই এত কিছু! ভাবা যায়!’’

নিখোঁজের খবর ছড়িয়ে পড়তেই উদ্বিগ্ন অভিভাবক-অভিভাবিকাদের একাংশ। বহরমপুরের বাসিন্দা লিলি ঘোষের মেয়ে শহরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করে। লিলির কথায়, ‘‘আমার মেয়ে ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। সময় পেলেই ইউটিউবে বিটিএস নিয়ে পাগলামি। সব সময় ওদের নকল করে। এটা আদৌ ভাল না খারাপ, সত্যিই বুঝতে পারি না মাঝেমধ্যে। কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারি না। মেয়ে আনন্দে আছে দেখে মুখ বুজে থাকি। এখন দেখছি আর চুপ থাকা যাবে না।’’

মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের মনোরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রঞ্জন ভট্টাচার্যের মত, ‘‘বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের মনের মধ্যে অনেক ঝড়ঝাপটা চলে। সহজেই যে কোনও রংচঙে জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয় অল্পবয়সিরা। অনেক সময়েই এই প্রবণতা হিস্টিরিয়ার চেহারা নেয়। অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। বাচ্চাদেরও কাউন্সেলিং দরকার।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement