বাড়ির সামনে উজ্জ্বল হালদার। নিজস্ব চিত্র
বড় হয়ে রাজ্যের বা দেশের ফুটবল খেলা ছিল তাঁর স্বপ্ন। সেই লক্ষ্য নিয়ে বছর পাঁচেক বয়সে এক দিন মাঠে অনুশীলন শুরু করেছিল কল্যাণীর বিজয়নগরের উজ্জ্বল হালদার। তাঁর সেই স্বপ্ন ভাগ্যদোষে পূরণ হয়নি। কিন্তু ময়দানও তিনি ছাড়েননি।
এখন আর ফুটবল না খেললেও জাতীয় স্তরের রেফারি হয়েছেন আঠাশ বছরের উজ্জ্বল। দক্ষ রেফারি হিসবে দেশের ফুটবল মহলে তাঁর বেশ নামডাক। অল্প সময়ের মধ্যে আইএফএ শিল্ড ফাইনাল, সন্তোষ ট্রফি ফাইনাল, আইএসএল, এমনকি সাফ গেমসের মতো আন্তর্জাতিক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ‘এলিট’ প্যানেলভুক্ত এই তরুণ রেফারি। কিন্তু একটি স্থায়ী রোজগারের উপায় করতে হন্যে হয়ে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে।
উজ্জ্বল বলেন, “রেফারি হিসাবে বড়-বড় ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করার সুবাদে দেশ-বিদেশের নামি রেফারি ও খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বিমানে যাতায়াত হচ্ছে। বিলাসবহুল হোটেলে থাকছি। কিন্তু যত দিন ফিটনেস থাকবে, তত দিন এ সব থাকবে। ফিটনেসের ঘাটতি হলে রেফারিং ছেড়ে ফিরে আসতে হবে একচিলতে টালির ঘরে। সংসার চালাতে মায়ের ছোট্ট চায়ের দোকান চালানো বা ভ্যানরিকশা টানা ছাড়া গতি থাকবে না।’’
পরিবার ও স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, ক্রীড়াপ্রেমী বাবার হাত ধরে খুব ছোট বয়সে মাঠে যাওয়া শুরু উজ্জ্বলের। মাত্র দশ বছর বয়সে বাবার মৃত্যু হয়। এর পরে জেলা স্কুলের খেলার আগে মাঠে অনুশীলনে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় পড়েন উজ্জ্বল। মায়ের চায়ের দোকানের আয় থেকে তাঁকে বাঁচানো সম্ভব নয় বুঝে সে দিন স্কুলের শিক্ষক ও প্রতিবেশীরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। অসুস্থতার কারণে প্রায় বছর তিনেক মাঠের বাইরে থাকতে হয় তাঁকে।
কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে দারিদ্র ঠেলে উজ্জ্বল ফের ফুটবল মাঠে ফিরে আসেন। রাজ্য স্কুল ফুটবলে সুব্রত কাপ ও রাজ্য ইউনিভার্সিটি ফুটবল দলের হয়ে খেলে বেশ সুনামও অর্জন করেন। কিন্তু বৃদ্ধা মায়ের ঘাড়ে সব চাপিয়ে সরে থাকতে পারেননি। বরং সংসারের হাল ধরতে কলেজ থেকে লেখাপড়ার পাট গুটিয়ে দিয়ে কখনও একশো দিনের কাজ, কখনও সামান্য টাকারর জন্য আবগারি অফিস সাফাইয়ের কাজও করতে হয়েছে।
উজ্জ্বলের কথায়, “তখন বিএ তৃতীয় বর্ষে পড়ি। আর পড়া চালানো সম্ভব হল না। সংসারে অভাব এতটাই যে পড়াশোনা ছেড়ে কাজে নামতে হয়। এই ভাবে খেলার মাঠ থেকে যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম, ততই বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নগুলোও শেষ হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে খেলা বিশেষ করে ফুটবলের প্রতি আমার আগ্রহের কথা জেনে এলাকার প্রবীর চক্রবর্তী আমায় রেফারি হওয়ার পরামর্শ দেন।’’
সেই থেকেই দ্বিতীয় ইনিংস শুরু। ২০১২ সালে বাংলার ফুটবল ম্যাচে অফিশিয়াল রেফারি হন উজ্জ্বল। ২০১৫-তে জাতীয় রেফারির স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর আক্ষেপ, অন্য রাজ্যে জাতীয় রেফারিরা অনেকেই সরকারি কাজ পেয়েছেন। কেন্দ্রের তৈরি করা ‘ক্রীড়ানীতি’র ভিত্তিতেও সরকারি কাজ পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি কাজের জন্য এর আগে মহকুমাশাসককে চিঠি দিয়ে কোনও উত্তর পাননি। স্থানীয় বিধায়কের কাছে আবেদন জানানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
রাজ্য সরকারের কোনও চাকরি কি পেতে পারেন না তিনি? প্রশ্নটুকুই এখন সম্বল উজ্জ্বলের।