ঘিঞ্জি পথের ধারে এক টুকরো ইট বের করা জমি কিংবা গ্রামের বাজারের মাঝখানে খোলা মেঠো জায়গা। মোটা ত্রিপল বিছানো। মাথার উপরে একশো ওয়াটের বড়জোর দু-তিনটি বাল্ব ঝোলানো। লোক টানার জন্য এইটুকু প্রস্তুতিই ঢের। দিনের বেলা এইসব সাজগোজ দেখলেই এলাকার মানুষ বুঝে নিতেন আজ রাতে ‘পালা’ হবে। সঙ্গে গরমাগরম বক্তৃতা। সন্ধ্যার পর ‘হ্যালো, হ্যালো, মাইক টেস্টিং’ শুনলেই সেই ত্রিপল বিছানো জায়গায় ভিড় জমে যেত মানুষের। গোল করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মাঝে সমতল মঞ্চেই শুরু হয়ে যেত ভোটের নাটক।
গত বিধানসভা এমনকী লোকসভা ভোটেও এই ধরনের প্রচার নাটকের বহুল ব্যবহার দেখা গিয়েছে সর্বত্র। অথচ চলতি বিধানসভা ভোটের প্রচারে সেইসব পথ নাটক বা প্রচার নাটকের দেখা জেলায় নেই বললেই চলে। হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠন যে পথে নামছেন না, এমন নয়। তবে অন্য বারের তুলনায় তা চোখে পড়ার মতো কম।
সাধারণত, বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠনগুলি এ ধরনের নাটকের মোড়কে তাদের দলীয় প্রচার সেরে থাকে। শাসক তৃণমূল কিংবা কংগ্রেস-বিজেপির মধ্যে এমন রীতি নেই। তবে এ বার বাম সংগঠনগুলিও যেন নাটক থেকে মুখ ফিরিয়েছে। গণনাট্য সঙ্ঘ, গণতান্ত্রিক লেখকশিল্পী সঙ্ঘের মতো বাম সাংস্কৃতিক সংগঠন বা গ্রুপ থিয়েটার – কেউই সেভাবে প্রচার নাটক নিয়ে পথে নামেনি এ বার। অথচ নাটক, গান, আলেখ্য-সহ লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপকরণে প্রচারকে আকর্ষণীয় করে তোলায় বামপন্থীদের জুড়ি ছিল না। এ বার তারা নেই কেন?
বৈদ্যুতিন প্রচার মাধ্যম, সোশ্যাল নেটওয়ার্কের ব্যবহার-সহ অনেক কিছু দিকেই আঙুল তুলছেন নাটকের মানুষেরা। তাঁদের কথা, নাটক করার জন্য অনুমতি সংক্রান্ত জটিলতা দিনে দিনে বাড়ছে। আগে যেখানে সেখানে যখন খুশি প্রচার নাটক করা যেত। সে ভাবে অনুমতির প্রয়োজন হত না। কিন্তু এখন নাটকের বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে কটা মাইক কোথায় বাঁধা হবে সব বিষয়ে এত কৈফিয়ত দিতে হয়, যে অনেকের ইচ্ছা থাকলেও উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন।
গণতান্ত্রিক লেখকশিল্পী সঙ্ঘের নদিয়া জেলা সম্পাদক শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় যেমন জানিয়েছেন নদিয়া জেলায় তাদের সংগঠনের তরফে জেলা জুড়ে তাদের ১৯টি শাখা অনান্য ভাবে প্রচারের কাজ শুরু করে দিয়েছে। এ বারে তাঁরা প্রচারে জোর দিচ্ছেন গান এবং কবিতার দিকে। শুভেন্দুবাবু বলেন, “এ জন্য আমরা ইতিমধ্যে সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে কৃষ্ণনগরে গত ৬ মার্চ একটি কর্মশালার আয়োজন করে ছিলাম। সেখানে কী ধরনের গান বা কবিতা প্রচারে ব্যবহার করা হবে সে সব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ঠিক হয়েছে গণতন্ত্রের সপক্ষে ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে, অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কবিতা এবং গান নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করা হবে।”
সেই মতো রবিবার বিকেলে কৃষ্ণনগর টাউন হলের সামনে গণতান্ত্রিক লেখকশিল্পী সঙ্ঘের সদস্যরা গান কবিতা আলেখ্য সহযোগে ভোটের প্রচার শুরু করে দিলেন। ছিলেন গণনাট্য সঙ্ঘের সদস্যরাও। গণনাট্য সঙ্ঘের নদিয়া জেলা সভাপতি নির্মল ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন তাঁরাও এ বার গানের উপর বেশি জোর দিচ্ছেন। জেলার সাতটি শাখা প্রচারে গণসঙ্গীত গাইবে, চারটি শাখা ঝাঁপান-সহ বিভিন্ন লোকগান গাইবে। তারই মধ্যে অবশ্য গণনাট্য সঙ্ঘের তাহেরপুর গণকন্ঠ শাখা মঞ্চস্থ করবে সমুদ্র গুহের নাটক ‘অলবেঙ্গল চোর অপেরা’ এবং কৃষ্ণনগর মডেনা শাখা মঞ্চস্থ করবে চন্দন ভট্টাচার্যের নাটক ‘শপথ’। দু’টি নাটকেই চারটি করে চরিত্র। তবে নাটকের গল্প নিয়ে তাঁরা মুখ খুলতে চান নি। নির্মল বাবু বলেন, “প্রথম নাটকের বিষয়বস্তু নাম থেকেই খানিকটা আন্দাজ করা যাচ্ছে।’’
কিন্তু যে সব গ্রুপ থিয়েটারে দল নিয়মিত ভোটের প্রচার নাটক করেন বলে পরিচিত, তাঁরাও এ বার নাটক নিয়ে প্রচারে সেভাবে নামেননি। চাকদহ, তাহেরপুরের দু-একটি দল প্রচার নাটকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত বারের বিধানসভা ভোটে প্রচারের জন্য কৃষ্ণনগরের ‘অরণী’ তৈরি করেছিল ‘তাঁরা সব বেঁচে আছে’ নামের একটি নাটক। তিরিশ বছর আগে সব জমি খাস হয়ে যাওয়ার শোকে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন এক জোতদার। হঠাৎ তিনি সুস্থ হয়ে ওঠার পর সেই জমি নিয়ে নানা জটিলতা ছিল সেই নাটকের বিষয় বস্তু। সেই নাটক জনপ্রিয়ও হয়েছিল।
এ বার অরণীর প্রচার নাটকের বিষয়বস্তু কী?
উত্তরে দলের পরিচালক সুজিত সাহা বলেন, “ এ বছর আমরা প্রচার নাটক করছি না।” কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সখেদে তিনি জানান, গত পাঁচ বছরে এই রাজ্যের নাগরিক সমাজের মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সেই পরিবর্তনে নাগরিক সমাজ তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে বাকিদের কাছে। এই সময়ের নিরিখে যা সবচেয়ে বড়ক্ষতি। সেই নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি হয়ে নাটক করতে
মন চায়নি।