নোংরা শৌচালয়। করিমপুরের একটি হাইস্কুলে। নিজস্ব চিত্র
যাতায়াতের দীর্ঘ পথে শৌচালয়ের অভাব এবং কর্মস্থলে শৌচালয়ের অস্বাস্থ্যকর, অপরিচ্ছন্ন দশা। এই জোড়া সমস্যায় জেলার বহু শিক্ষিকাকে দিনের একটা লম্বা সময় মলমূত্রের বেগ চেপে রাখতে হয়। অথবা ব্যবহার করতে হয় নোংরা শৌচালয়। এর ফলে তাঁদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বিকোলাই, কিডনিতে পাথর, মূত্রনালীর সংক্রমণের মতো নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ঋতুকালীন সময়ে তাঁদের দুর্ভোগ চরমে উঠছে, কিন্তু অভিযোগ কর্তৃপক্ষের তাতে কোনও হেলদোল নেই।
স্কুলে যোগ দেওয়ার পরে তখন মাত্র কয়েক মাস কেটেছে। আচমকা এক দিন স্কুলেই ‘পিরিয়ড’ শুরু হয়ে গিয়েছিল। অথচ স্কুলে শিক্ষিকাদের জন্য আলাদা শৌচাগার নেই। অসহায় লেগেছিল হিজুলির একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা সুব্রতা পালের। ব্যবহার করতে হয়েছিল সেই অপরিচ্ছন্ন ‘কমন’ শৌচালয়। সেখানেই স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তন করতে হয়েছে একাধিক বার।
প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকাদের একটা বড় অংশ প্রতিদিন কর্মস্থলে পৌঁছতে বহু দূর যাতায়াত করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় বাসে-ট্রেনে। স্টেশন বা বাসস্ট্যান্ডে শৌচাগারগুলির অবস্থা কহতব্য নয়। আবার যখন দীর্ঘ পথ পার হয়ে স্কুলে পৌঁছোন সেখানেও শৌচালয়ের দশা তথৈবচ। সেখানেও ঘেন্নায় অনেকে বাথরুমে যেতে চান না। চেপে রাখেন। আর দিনের পর দিন এমন দুর্বিসহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়ে অবশেষে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক শিক্ষিকার কথায়, “বাড়ি থেকে দেড় ঘন্টা বাসে চেপে স্কুলে আসতে হয়। সেখানেও মেয়েদের আলাদা শৌচাগার নেই। কমন শৌচালয়ের অবস্থা নরকতূল্য।”
অনেক শিক্ষিকা প্রতিদিন ১৬০ থেকে ৩৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাস ও ট্রেনে যাতায়াত করেন। যেমন করিমপুর জগন্নাথ হাইস্কুলের স্কুলের শিক্ষিকা শিল্পী দত্তকে প্রতিদিন আসা-যাওয়া মিলিয়ে প্রায় ৩৬০ কিলোমিটার পথ পার হতে হয়। ভোর পাঁচটায় বাড়ি থেকে বের হয়ে আড়াই ঘন্টা ট্রেন ও তার পর আড়াই ঘন্টা বাসে চেপে তবেই পৌঁছোন স্কুলে। আসতে-যেতে প্রায় এগারো ঘণ্টা কাটে পথে। মাঝে এমন কোনও পরিচ্ছন্ন শৌচাগার মেলে না যা তিনি ব্যবহার করতে পারেন। তাঁর স্কুলে ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের জন্য একটিই শৌচাগার। সেটাও আবার নিয়মিত পরিষ্কার হয় না। শিল্পীদেবী বলেন, “ঘণ্টার পর ঘণ্টা মূত্রের বেগ চেপে রাখার কারণে অনেক দিন রাতেই তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। সব সময় ‘চেপে’ থাকাটাই যেন আমাদের ভবিতব্য। যাঁরা সারাদিন এসি ঘরে থাকেন তাঁরা এ সব বুঝবেন না, তাই অনেক কথাই বলতে পারেন।”
চাকদহ থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করেন চাপড়ার বড় আন্দুলিয়া হাই স্কুলের শিক্ষিকা শর্মিষ্ঠা কর্মকার। দীর্ঘ যাতায়াত পথে অনেক সময় স্টেশন বা বাসস্ট্যান্ডের শৌচাগার ব্যবহার করতে বাধ্য হন। মূত্রনালীর সংক্রমণ এবং বিকোলাই হয়ে গিয়েছে তাঁর। বলেন, “তা-ও আমার স্কুলের শৌচালয় ভাল। আমার সঙ্গে এমন অনেক শিক্ষিকা যাতায়াত করেন যাঁদের স্কুলের শৌচাগারের অবস্থা কহতব্য নয়। সেখানে জল নেই। এত কষ্ট করার পরও শিক্ষামন্ত্রীর কথাটা শুনে খুবই কষ্ট হচ্ছে। অবাক হয়ে যাচ্ছি যে, আশপাশের মানুষেরা সেটা শুনে হাততালি দিলেন!’’
অনেকেই ভুক্তভোগী, তাঁরাও ক্ষুব্ধ, আহত, কিন্তু প্রকাশ্যে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ, বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে শিক্ষামন্ত্রী। এক শিক্ষিকা যেমন করুণ স্বরে বলছেন, “আমাকে ছেড়ে দিন। অন্য জেলা থেকে চাকরি করতে আসি। অসুবিধা তো হয়। কিন্তু সে সব বলে বিপদ ডেকে আনতে চাই না।” অনেক শিক্ষিকাই জানিয়েছেন, শৌচাগারের অভাবে পিরিয়ডের কয়েক দিন অনেকেই স্কুল কামাই করতে বাধ্য হন। তাঁদের অভিযোগ, দেশজুড়ে সরকারি স্তরে শৌচালয় গড়ার এত তোড়জোড়, এত প্রচার। কিন্তু গ্রামের দিকে স্কুলে-স্কুলে শিক্ষিকাদের আলাদা শৌচালয়, তার পরিচ্ছন্নতা ও জলাভাবের বিষয়টি অসম্ভব অবহেলিত।