শিশুদের অস্ত্র করে এ ভাবেও চলে পাচার। —ফাইল চিত্র
বড় হয়ে কী হবি?’
কোনও কিছু না ভেবে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রটি শিক্ষিকাকে সটান জানিয়েছিল, ‘কেন, বাবার মতো ডিল (ফেনসিডিল) পার করব।’
জলঙ্গি সীমান্তের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ক্লাসে ওই শিক্ষিকা পড়ুয়াদের জিজ্ঞাসা করছিলেন, তারা বড় হয়ে কী হতে চায়? কেউ ডাক্তার, কেউ শিক্ষক, কেউ আবার ব্যবসায়ী হতে চেয়েছিল। কিন্তু ক্লাসের ওই পিছন থেকে ‘বাবার মতো ডিল পার’ করতে চাওয়া পড়ুয়ার উত্তর শুনে চমকে উঠেছিলেন মফস্সলের ওই শিক্ষিকা। পরে আলাদা ভাবে ওই পড়ুয়ার সঙ্গেও তিনি কথা বলেছিলেন।
করিমপুরের বাসিন্দা ওই শিক্ষিকার কথায়, ‘‘ছাত্রটির উত্তর শুনে প্রথমে চমকে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু পরে ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি যে ওর পক্ষে এমন উত্তর দেওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ ওর বাবা পাচার করে। বাড়িতে মজুত থাকে ফেনসিডিল। এ সব দেখে সেও ভেবে নিয়েছে এটাও তো ব্যবসা। ফলে বড় হয়ে এই কাজ করা যেতেই পারে। পরে অবশ্য ওকে বুঝিয়ে বলেছি যে, কাজটা বেআইনি।’’
মুর্শিদাবাদের তৃতীয় শ্রেণির ওই পড়ুয়া বড় হয়ে ফেনসিডিল পাচার করতে চেয়েছিল। কিন্তু নদিয়ার শিকারপুরের বছর আটেকের মনিরুল শেখ (নাম পরিবর্তিত) ফেনসিডিল পাচার করার সময় ধরা পড়ে গিয়েছিল বিএসএফের হাতে। সবে আড়মোড়া ভেঙেছে শীতের সীমান্ত। ঠিক তখন শিকারপুর বর্ডার আউট পোস্ট থেকে কিছুটা দূরে বিএসএফ দেখতে পায় ওই বালক মাথাভাঙার পাশে ঘোরাঘুরি করছে। সন্দেহ হয় বিএসএফের। দুই জওয়ান গিয়ে তাকে চেপে ধরতেই কান্নাকাটি শুরু করে মনিরুল। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বেশ কয়েকটি ফেনসিডিলের শিশি।
মনিরুল ও তার মাকে জিজ্ঞাসা করে বিএসএফ জানতে পারে, বিএসএফের নজরদারি বাড়াতেই চাপে পড়ে যায় এলাকার জনাকয়েক পাচারকারী। তারাই মনিরুলের মতো বেশ কয়েকজনকে দিয়ে ফেনসিডিল পাঠাত মাথাভাঙার পাড়ে। বিনিময়ে মনিরুলরা পেত একশো থেকে দেড়শো টাকা। অভাবের সংসারে তাই অনেক।
মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ায় এমন নজির আরও রয়েছে। কোথাও পঙ্গু বাবার হয়ে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তেরো বছরের কিশোরকে। সাবালক না হওয়ায় মেলে না একশো দিনের কাজ। অগত্যা কখনও গাঁজার প্যাকেট, কখনও ফেনসিডিল ছুড়ে দেওয়া তারকাটার ওপারে। ক্ষুব্ধ সেই কিশোর অনায়াসে বলতে পারে, ‘‘জানি কাজটা বেআইনি। কিন্তু সংসার চালাতে এই মুহূর্তে এটা ছাড়া আমার সামনে অন্য পথ খোলা নেই।’’
শিশু পাচারকারীদের গল্প বিএসএফ জওয়ানদের ঝুলিতেও বড় কম নেই। একজন শোনাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। ভোরের কুয়াশায় ঢেকে আছে চরাচর। সেই কাকভোরে হাঁটু-জল পদ্মা পেরিয়ে সেই জমাট কুয়াশা ফুঁড়ে উদয় হল দু’জন ছোট ছেলেমেয়ে। মাথায় ঘাসের বোঝা। মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি সীমান্তে ওই দু’জনকে দেখে বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থাকা ওই জওয়ানের মনে পড়ে গিয়েছিল নিজের ছেলেমেয়ের কথা। “কী রে তোদের পড়াশোনা নেই...?” জওয়ানের মুখের কথা শেষ না হতেই ঘাসের বোঝা ফেলে একছুটে চোখের আড়ালে চলে যায় ওই দু’জন। পড়ে থাকা ঘাসের বোঝা খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ! ঘাসের মধ্যে চকচক করছে চারটে সোনার বিস্কুট।
পুলিশ ও বিএসএফ সূত্রে খবর, পাচারের কাজে কখনও শিশু, কখনও মহিলাদের ব্যবহার করে পাচারকারীরা। কিন্তু সীমান্তে এখন মহিলা বিএসএফ আসায় ও এলাকার মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ায় ওই প্রবণতায় অনেকটাই রাশ টানা গিয়েছে বলে দাবি প্রশাসনের। হোগলবেড়িয়া আদর্শ শিক্ষানিকেতনের প্রধানশিক্ষক বিমলকৃষ্ণ বিশ্বাস বলছেন, ‘‘একটা সময় সীমান্তে বহু ছাত্র পাচারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। তবে এখন অবশ্য ছবিটা অনেকটাই বদলাচ্ছে। এলাকায় শিক্ষার হার বেড়েছে। সীমান্তের প্রত্যন্ত এলাকার ছেলেমেয়েরা ভাল রেজাল্ট করে চাকরি করছে, এমন নজিরও রয়েছে। সচেতনতা বেড়েছে অভিভাবকদের মধ্যেও। আমার স্কুলে এমন অনেক পাচারকারীই এসে বলেছে—‘ছেলেটাকে একটু দেখবেন মাস্টারমশাই। বড় হয়ে যেন আমার মতো এই কাজ না করতে হয়।’ এটা কিন্তু বড় আশার কথা।’’ বটেই তো। না হলে সীমান্তের এমন অসময়োচিত বিপন্নতা আরও বাড়তেই থাকবে।