তালের বড়ার দখল মা-পিসিমাদের হাত থেকে মিষ্টির দোকানের কারিগরদের হাতে চলে গিয়েছে।
তালনবমীর জন্য জটি পিসিমার কাছে যেচে পড়ে পাকা তাল বেচতে গিয়েছিল দুই ভাই নেপাল আর গোপাল। এমনিতে পয়সায় দুটো করে দিলেও পিসিমার জন্য নেপাল পয়সায় তিনটে করে তাল দিয়েছিল। দরাদরি শেষে জটি পিসিমা বলেছিল— ‘বেশ কালো হেঁড়ে তাল তো? আমাদের তালের পিঠে হবে তালনবমীর দিন— ভালো তাল চাই।’
বিভুতিভূষণের ‘তালনবমী’ গল্পের নেপাল-গোপালেরা এখনও একই ভাবে যেচে তালের খোঁজ নিয়ে আসে। তবে জটি পিসিমা নয়, এখন তাদের খরিদ্দার শহরের মিষ্টির দোকানিরা। কেননা, গত কয়েক বছর হল তালের বড়ার দখল মা-পিসিমাদের হাত থেকে মিষ্টির দোকানের কারিগরদের হাতে চলে গিয়েছে।
জন্মাষ্টমীর ক’দিন আগে থেকেই পূর্বস্থলী, লক্ষ্মীপুর থেকে ‘ভাল তাল’ বেচতে নবদ্বীপে চলে আসেন গ্রামীণ মহিলারা। বাজারের খুচরো ক্রেতা নয়, তাদের লক্ষ্য মিষ্টির দোকান। জন্মাষ্টমীর সময়ে তালের বড়ার বিকিকিনির কাছে রসগোল্লা-সন্দেশও পাত্তা পায় না। জন্মাষ্টমীর সঙ্গে তালের বড়ার সম্পর্ক কবে থেকে, তার কোনও হদিস না মিললেও। ‘তালের বড়া খেয়ে নন্দ নাচিতে লাগিল’ এমন ছেলে ভুলোনো ছড়া বিভুতিভূষণের ঢের আগে লেখা। আর ভাল পাকা তালের দাম আর মোটে এক দু’পয়সা নয়, কুড়ি থেকে পঞ্চাশ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।
নবদ্বীপ হোক বা কৃষ্ণনগর বা শান্তিপুর— শহরের মিষ্টির দোকানে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে তালের বড়ার বিক্রি চমকে দেওয়ার মতো। সেই সঙ্গে মালপোয়া। কৃষ্ণনগরের পুরনো মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী তাপস দাস বলেন, “কয়েক বছর ধরেই জন্মাষ্টমীতে তালের বড়া মালপোয়া কেনার ধুম পড়েছে। আবার সেটা এতটাই বেশি যে আমাদের অনুমানের বাইরে চলে গিয়েছে।” প্রথম খেপে তাপসবাবু যে পরিমাণ তালের বড়া আর মালপোয়া করেছিলেন শুক্রবার সকালের মধ্যে তা সাফ। প্রবল চাহিদা থাকায় ফের সব জোগাড় করে দুপুর থেকে নতুন করে সব তৈরি করতে লেগেছেন।
অন্য দিকে নবদ্বীপের ছোটবড় সব দোকানেই বিপুল পরিমাণে তৈরি হচ্ছে তালের বড়া। মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী লালু মোদক জানান, “ষাটটা তাল লেগেছে এখনও পর্যন্ত। তার সঙ্গে আটা, সুজি, কলা, আখের গুড়, নারকেল, দুধ— সব মিলিয়ে পঞ্চাশ কেজি তালের বড়া করেও কুল করতে পারছি না। সেই সঙ্গে মালপোয়া করেছি চার হাজার পিস। নবদ্বীপে দু’দিন দুই মতে জন্মাষ্টমী। ফলে শনিবারও প্রচুর চাহিদা থাকবে।”
বাজারে তালের দামও বেশ চড়া। নবদ্বীপ বা কৃষ্ণনগরে কুড়ি টাকা থেকে শুরু হয়েছে তালের দাম। প্রমাণ সাইজের ভাল তাল এ দিন প্রতিটি পঞ্চাশ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। তালের বড়ার দামও নানা রকম। কৃষ্ণনগরে তিনশো টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে তালের বড়া। নবদ্বীপে দাম শুরু হয়েছে দেড়শো টাকা থেকে। ঊর্ধ্বে আড়াইশো টাকা। মালপোয়া প্রতিটি পাঁচ টাকা। কিন্তু চৈতন্যধাম নবদ্বীপ বা মায়াপুরের জন্মাষ্টমী শুধু মাত্র তালের বড়ায় সীমাবদ্ধ থাকে না। পায়েস, মালপোয়া, ক্ষীর, রাবড়ি থেকে আট কলাই নানা রকম বিশেষ খাবারে সাজানো হয় জন্মদিনের ভোগের ‘পারস’।
কারা কিনছেন তালের বড়া বা মালপোয়া? দোকানদারেরা জানাচ্ছেন, বাড়ির গৃহদেবতাকে ভোগ দেওয়া জন্য সাধারণ গৃহস্থ থেকে মঠ-মন্দিরের ভক্ত-সাধু সকলেই আসছেন কিনতে। তালের বড়া তৈরির পরিশ্রম থেকে রেহাই পেয়ে দোকান থেকে কিনতেই হয়তো বেশি পছন্দ করছেন অনেক বাড়ির কর্ত্রীও।
(উদ্ধৃতির মধ্যে বানান অপরিবর্তিত)