কল্যাণী জেএনএম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। ছবি:সুদেব দাস।
আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়ার ধর্ষণ-খুনের পরে রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজেই ‘উত্তরবঙ্গ লবি’ ঘনিষ্ঠ হুমকি-চক্রের পান্ডারা চাপে পড়ে গিয়েছিল। কল্যাণী জেএনএম-ও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশেষত আর জি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ গ্রেফতার হওয়া এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের চিকিৎসক নেতা অভীক দে সাসপেন্ড হওয়ার পরে কল্যাণীতে পরিস্থিতির দ্রুত বদল ঘটে। কিন্তু ফের সেখানে হুমকি-সংস্কৃতি চালু হবে কি না সেই আশঙ্কা শিক্ষক ও পড়ুয়া মহলে দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
এই আশঙ্কার কারণ ধর্ষণ-খুনের মামলায় সিবিআই ৯০ দিনেও চার্জশিট দিকে না-পারায় সন্দীপ ঘোষের জামিন। যদিও দুর্নীতি মামলায় জামিন না হওয়া ইস্তক সন্দীপ হাজতের বাইরে আসতে পারবেন না, কিন্তু এই ঘটনায় তাঁর ‘অনুগত বাহিনী’র মনোবল বাড়বে বলে বিভিন্ন মহলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই সন্দীপ-অনুগত অভীকের অনুগামীরাই বছরের পর বছর জেএনএমে হুমকি চক্র চালিয়ে এসেছে বলে অভিযোগ। তোলাবাজি, মারধর, পরীক্ষার ফল প্রভাবিত করা, র্যাগিং— তাদের বিরুদ্ধে ভূরি-ভূরি অভিযোগ সামনে এসেছিল।
অভীক সাসপেন্ড হওয়া এবং জেএনএমের তদানীন্তন অধ্যক্ষ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় কলেজের (ইনিও অভীক-ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত ছিলেন) অপসারিত হতেই কলেজের অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি নতুন করে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা সাহস করে কমিটির সামনে নির্দিষ্ট অভিযোগ জানান। তার ভিত্তিতে তদন্ত করে ৪০ জন ছাত্রছাত্রীকে ছ’মাসের জন্য কলেজ ও হস্টেল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। কিন্তু এর পর অভীক দে-র কার্যত তেমন কিছু শাস্তি হয়নি, উল্টে ৪০ জনের সাসপেনশনে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। শুক্রবার সন্দীপ ঘোষের জামিন হয়ে যাওয়ায় এ বার শুধু হতাশ নয়, আশঙ্কিত হয়ে পড়ছেন জেএনএমে হুমকি-চক্রের বিরুদ্ধে সরব হওয়া সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা তৃণমূল-আশ্রিত ওই ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় এ বার তাঁদের নিশানা করা হবে কি না, সেই ভয় পাচ্ছেন অনেকেই।
একটা আশঙ্কার বাতাবরণ যে তৈরি হয়েছে, তা শনিবারই স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে। প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে এ দিন বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা কেউ এই নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে কয়েক জন বলেছেন, “যাঁদের বিরুদ্ধে আমরা অ্যান্টি র্যাগিং কমিটির কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলাম, এখনই হয়তো তারা ফের মাথাচাড়া দেওয়ার জায়গায় ফেরেনি। কিন্তু বাইরের ইন্ধনে আগামী দিনে স্বরূপ ধারণ করলে তারা যে বেছে-বেছে আমাদের নিশানা করবে না, তা কে বলতে পারে?”
উল্টো দিকে, র্যাগিংয়ে অভিযুক্ত পড়ুয়া বা জুনিয়র ডাক্তারদেরও অনেককে ফোন করা হয়। কেউ ফোন তোলেননি, কেউ আবার ফোনে কথা বললেও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি। হুমকি-চক্রে অভিযুক্ত তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্র আবার দাবি করেন, "আমাদের সঙ্গে যা হয়েছে, তা মোটেই কাম্য ছিল না। কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থে, চেয়ার বাঁচাতে আমাদের কালিমালিপ্ত করেছেন।" এই হুমকি-চক্রের ‘মধ্যমণি’ হিসাবে যাঁর দিকে সবচেয়ে বেশি অভিযোগের আঙুল উঠেছে, অভীক-অনুগত সেই স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্র শেখ মহম্মদ অখিল অবশ্য বলেন, “বিষয়টি বিচারাধীন। আমি আর এ সবের মধ্যে জড়াতে চাই না।”
যদি সত্যি করেই ফের জেএনএমে হুমকি-প্রথা কায়েমের চেষ্টা হয় এবং অভিযোগকারীদের নিশানা করা হয়, সে ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেবেন কলেজ কর্তৃপক্ষ?
জেএনএমের ডিন অব স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স তথা অ্যান্টি র্যাগিং কমিটির সদস্য সৌগতকুমার বর্মণ বলেন, "সব কিছুই বর্তমানে স্বাভাবিক আছে। নতুন করে যদি সমস্যা তৈরি হয়, সে ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।" হস্টেল সুপার সৌম্যজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাস, "পরিস্থিতির দিকে সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে।” যদিও অভিযুক্ত ছাত্রদের ক্লাস করতে দিলেও এখনও কলেজ হস্টেলে ফেরার অনুমতি দেয়নি হাই কোর্ট।
জেএনএমের অধ্যক্ষ মণিদীপ পাল বলেন, "যেহেতু বিষয়টি বিচারাধীন, তাই এই নিয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে এখনও অভিযোগকারী পড়ুয়াদের কাউকে হুমকি দেওয়া বা ওই ধরনের কিছু ঘটেনি। কলেজ প্রশাসন এবং অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি ওয়াকিবহাল আছে।"