Durga Puja Special

বাইরে ঢাক বাজে, ঘরে কাঁদে উমা

প্রায় ২২ হাজার বছর আগে ভারতে প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠী থেকেই দেবী পূজার প্রচলন হয় বলে অনেক ঐতিহাসিকের মত। সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরও গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃততর হয়।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২২ ০৯:৫৫
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ

কলকাতা-ঘেঁষা দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক গ্রাম। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উঠোনে বসে কথা হচ্ছিল মেয়েদের সঙ্গে। বয়স প্রত্যেকের ১৩ থেকে ২১ বছরের মধ্যে। বিচিত্র এক সমস্যা শুনেছিলাম ওদের মুখে।

Advertisement

গ্রামের যে প্রধান রাস্তা দিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় ওরা সাইকেল চালিয়ে কোচিংয়ে যায়, তার দু’ধারে লাগানো আলোগুলো নিয়মিত ঢিল মেরে ভেঙে দেয় এলাকার কিছু ছেলে। রাস্তা অন্ধকার থাকলেই তো মেয়েদের মনে বেশি করে নিরাপত্তার অভাবের ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে সাইকেল আটকে অশালীন কথা বলা যায়, ওড়না ধরে টানা যায়, শরীরে হাত দেওয়া যায়। ভয় পেয়ে অনেক অভিভাবক কোচিং ছাড়িয়ে দিতে শুরু করেন মেয়ের।

মেয়েরা ভয় পেয়ে থামেনি। রুখে দাঁড়িয়েছিল। বারবার স্থানীয় পুর প্রতিনিধি এবং থানায় দরবার করে হাজতে ঢুকিয়েছিল বাল্‌ব ভাঙার পান্ডাদের। জেল থেকে বেরিয়ে তারা প্রতিশোধ নিতে পারে, সেই আশঙ্কাও ছিল। তাই কোচিংয়ে যাওয়ার পথে প্রত্যেকে ব্যাগে সঙ্গে রাখত কৌটো ভর্তি লঙ্কা-গোলমরিচের গুঁড়ো, কাঁচি-ছুরি। সেই কথা বলার সময় সদ্য কিশোরীদের চোখে ছিল তেজ, জেদ, সঙ্কল্প মেশানো অদ্ভুত দীপ্তি!

Advertisement

হয়তো ছোট্ট একটা ঘটনা। কিন্তু ইঙ্গিতবাহী।

এই আপাত সাধারণ মেয়েরাই তো শক্তি, স্থিতির আধার। প্রতিনিয়ত যারা লড়াই করছে অশুভ শক্তির সঙ্গে। আমরা দুর্গা শক্তির আরাধনা করি। তাঁর পায়ে নত হই। কিন্তু প্রকৃত মাতৃশক্তিকে মানসিক ভাবে কত জন স্বীকার করতে পেরেছি? সম্মান দিতে শিখেছি? পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে নারীকে হীন, হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা। তার এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকে বারবার রুদ্ধ করার জন্য রয়েছে নানা ফন্দি।

নারীর জীবন নির্ধারণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ণ, পরিবার ও সমাজে তাকে কাম্য করে তোলা এবং সম্মান দেওয়ার মতো বিষয়গুলিকে যত দিন না আমরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে স্বীকৃতি দিতে পারব ততদিন মাতৃশক্তি আরাধনার আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ, লোক-দেখানো, আড়ম্বরসর্বস্ব হয়ে থাকবে।

সেই কবে ভার্জিনিয়া উল্‌ফ তাঁর ‘আ রুম অব ওয়ানস ওন’ বইয়ে লিখে গিয়েছিলেন, ‘‘The history of men’s opposition to women’s emancipation is more interesting perhaps than the story of that emancipation itself.’’ বন্ধনমুক্তির নিজের গল্পের থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় নারীর বন্ধনমুক্তিতে পুরুষের বিরোধিতার ইতিহাস। কী প্রাসঙ্গিক সে কথা এ যুগেও!

তাই তো বহিরঙ্গে মাতৃশক্তির উদ্‌যাপন করা আমাদের অনেকেরই পরিবারে মেয়ের জন্মে পরিজনদের মুখের হাসি ম্লান হয়। জীবনের একেবারে প্রাথমিক পর্ব থেকে শুরু হয় লিঙ্গভেদ, বিভাজন, বৈষম্য। মেয়েদের এটা করতে নেই, এ ভাবে চলতে নেই, এ ভাবে খেতে নেই, এ ভাবে বসতে নেই। আমাদের সাধারণ কথোপকথনের মধ্যে মিশে যাওয়া বাক্যগুলোকে লক্ষ্য করুন—‘মেয়েদের মতো কাঁদিস না, মেয়েদের মতো হাঁটিস না, হাতে চুড়ি পরে বসে থাক, ঘোমটা দিয়ে থাক....’। প্রতিটি শব্দে মেয়েদের প্রতি নিক্ষিপ্ত একরাশ বিদ্রুপ, অসম্মান, অবজ্ঞা। বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যে পুরুষের থেকে তারা কতটা হীন। এই সমাজের মানসিকতা না বদলালে মাতৃশক্তির আরাধনা কি পূর্ণতা পেতে পারে?

আমার এক পরিচিত তথাকথিত শিক্ষিত, বিত্তবান পরিবারের এক মহিলাকেই সে দিন তাঁর নাতির উদ্দেশে বলতে শুনলাম, ‘‘পড়াশোনা করছিস না, মেয়ে হলে অত চিন্তা করতাম না। বিয়ে দিয়ে দিলেই হল। কিন্তু ছেলে তো, কিছু তো করে খেতে হবে!’ কত সহজে শৈশব থেকে আমরা মনের ভিতর গেঁথে দিচ্ছি বিভাজনের বীজ। মেয়েদের পুতুল খেলতে হয়, ছেলেদের ফুটবল-ক্রিকেট। তার উল্টোটা হলে হাজারো প্রশ্ন আর কৌতূহল। মেয়েদের নরমসরম হতে হয়, ছেলেদের ডানপিটে। অসুরসংহারি দুর্গার উপাসনা করা আমাদের পছন্দ ঘরোয়া, শান্তশিষ্ট, লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে! এমন দ্বিচারিতা দূর্গা সইবেন কিনা সন্দেহ!

আবার ভার্জিনিয়া উল্‌ফের লেখা মনে পড়ে যায়, ‘‘A women knows very well that, though a man sends her his poems, praised her judgment, solicits her criticism and drinks her tea, this by no means signifies that he respects her opinion, admires her understanding....’’। সেকাল হোক বা এ কাল, ছাতা পড়া মানসিকতা ধুয়ে-মুছে সাফ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। ‘বলো দুগ্গা মাইকি’ চিৎকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অজস্র মেয়ের আর্তনাদ।

আমাদেরই চারপাশে জোর করে ঠিক করা বিয়ের হাত থেকে বাঁচতে বাড়ি পালানো চোদ্দো-পনেরোর মেয়েগুলো অসহনীয় অসহায়তা নিয়ে বলে, ‘‘পড়াশোনা করতে চাই।’’ একই শ্রমে পুরুষের অর্ধের মজুরি পায় নারী। ‘গলগ্রহ’ মনে করা মেয়েদের কোনও মতে দূর করতে সব জেনেও অভিভাবকেরা তুলে দেন পাচারকারীর হাতে। যতই বেআইনি হোক না কেন, গোপনে দেদার চলে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ আর কন্যাভ্রূণ হত্যা। আর প্রতিদিন একের পর এক খবর আসে বিভিন্ন বয়সি নারীদেহ ধর্ষণ করে খুন করে ফেলার। এই সব কিছু মধ্যে দাঁড়িয়ে অষ্টমীর অঞ্জলী দিতে গিয়ে হাত কেঁপে যায়।

প্রায় ২২ হাজার বছর আগে ভারতে প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠী থেকেই দেবী পূজার প্রচলন হয় বলে অনেক ঐতিহাসিকের মত। সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরও গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃততর হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের মা-ই প্রধান শক্তি, তাঁর নেতৃত্বে সংসার পরিচালিত হয়, তাঁর নেতৃত্বে শত্রু নাশ হয়। তাঁকে সামনে রেখে ‘দেবী’-র ধারণা গড়ে ওঠে। দেবী শক্তির রূপ, তিনি পরমব্রহ্ম। বৈদিক সমাজের প্রথম দিকেও নারীর অধিকার স্বীকৃত হয়। আবার নৃতত্ববিদদের অনেকেই মনে করেন, যখন থেকে নারীর সন্তানধারণ ও জন্মদানের ক্ষমতা মানুষকে বিস্মিত করেছিল, তখন থেকেই নারীপূজা শুরু হয়েছিল বিভিন্ন গোত্র ও সমাজে। কিন্তু পরে বিয়ের ধারণা ও লিঙ্গীয় শ্রম বিভাজনের কারণে নারীকে দেখা শুরু হয় ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তির মতো এবং পুরুষের চেয়ে ‘নিচু’ হিসেবে।

প্রথমে পুরুষ ছিল শিকারী আর নারী সংগ্রহকারী। খাদ্য উৎপাদনের কাজে পুরুষের সাহায্যকারীও ছিল নারী। পরে নারীকে বেশি করে আবদ্ধ করা হয় গেরস্থালির কাজে। সে কাজ যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, তাকে ‘অনুৎপানদনশীল’ হিসাবে গণ্য হল। তাতে মজুরিও নেই। ফলে মর্যাদায় নারী চলে আসে শূদ্রের পর্যায়ে বা পুরুষের দাসের জায়গায়। মেয়েদের অধিকার ও মর্যাদার সেই উত্থান-পতন ও লড়াই সমানে চলেছে।

সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব একা ঘাড়ে বহন করা নারীকে উপার্জনক্ষম স্বামী শুধু অর্থের ক্ষমতায় সর্বসমক্ষে ‘তুমি কী বোঝ, চুপ করো তো, ভিতরে যাও’ বলে অপমান করতে পারেন। ‘মেয়েদের বুদ্ধি’ মন্তব্য করে ব্যঙ্গের হাসি হেসে আত্মপ্রসাদ লাভ করা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। চাকরি করা মেয়েটির কাছেও বাড়ির সবাই প্রত্যাশা করেন যে তিনি বাড়ির কাজও একই রকম ভাবে সামলাবেন, যে প্রত্যাশা তাঁর স্বামীর কাছ থেকে কেউ করেন না। কাকভোরে উঠে বাড়ির সকলের রান্না করে ট্রেন ধরে কলকাতায় আসেন এক মেয়ে। আয়া বা পরিচারিকার কাজে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বাড়ি গিয়ে ফের রান্না করেন এবং মদ্যপ স্বামীর মার সহ্য করেন। অনেক পুরুষের কাছে ‘বউ পেটানো’ অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাতে বউকে নিজের কব্জায় রাখা যায়।

কর্মক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে নারীকে লড়াই করতে হয় পুরুষের দ্বিগুণ। কারণ, প্রাথমিক ভাবে অনেকে এখনও ধরে নেন, মহিলা কর্মী মানে সারা দিন উল বুনে বাড়ি চলে যাবে। পুরুষ কর্মীর সঙ্গে সমানে-সমানে কাজে টক্কর দিতে দেখলেই পৌরুষত্বের বিপদঘণ্টি বেজে ওঠে। শুরু হয় প্রতিরোধ। ঘরে-বাইরে যুদ্ধ শুরু হয় নারীর।

তাই জাঁকজমক, তুমুল আয়োজনে মাতৃশক্তির আরাধনায় গা ভাসানোর আগে মনে করা যাক মনুবাক্য— ‘‘যত্র নার্যস্তু পয়জ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। / যত্রৈতাস্তুন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রফলাঃ ক্রিয়া।’’ অর্থাৎ যেখানে নারী পূজিতা, সেখানে দেবতাও খুশি হন, যেখানে তাঁদের পূজা নেই, সেখানে সকল ধর্মকর্মই নিস্ফল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement