তর্পণের প্রস্তুতি। বুধবার নবদ্বীপে। নিজস্ব চিত্র
হিসেবটা মিলছে না এ বার! মহালয়ার এক সপ্তাহের মাথায় পুজো, এটাই চিরকালীন নিয়ম। তর্পণের অমাবস্যা শেষে হয়ে শুক্ল প্রতিপদ শুরু হওয়া মানেই পিতৃপক্ষ শেষ করে দেবীপক্ষের সূচনা। কিন্তু এ বার আর ষষ্ঠীতে বোধনের ঢাকে কাঠি পড়তে ছ’দিন নয়, পাক্কা ছত্রিশ দিনের অপেক্ষা। ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫.০৪ মিনিটে অমাবস্যা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিতৃপক্ষ শেষ। কিন্তু দেবীপক্ষের সূচনা হতে সেই ১৭ অক্টোবর।
মাঝে আশ্বিন মাসটি এ বার পঞ্জিকা মতে ‘মল মাস’ বলে চিহ্নিত। মল মাস মানে যে মাসে দুটি অমাবস্যা তিথি থাকে। এ মাসে কোনও শুভকাজ বা উৎসব-পার্বণ নিষিদ্ধ। তারই জেরে আশ্বিনের শারদপ্রাতে নয়, দুর্গাপুজো এ বার হিম-হিম কার্তিকে। এর আগে ২০০১ বা তারও আগে ১৯৮২ সালেও পুজো হয়েছিল কার্তিকে। আবার ২০৩৯ সালেও তা-ই হওয়ার সম্ভাবনা। পণ্ডিতেরা বলছেন, তিথি-নক্ষত্রের জটিল হিসাব মেলাতেই এই মল মাসের অবতারণা। প্রত্যেক তিন থেকে সাড়ে তিন বছরের মাথায় একটি করে মাস হয় মল মাস। প্রতি উনিশ বছর অন্তর আশ্বিন হয় মল মাস।
প্রবীণ পণ্ডিত শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা: যাবতীয় পুজোবিধি নিয়ন্ত্রিত হয় সূর্য এবং চন্দ্রের সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমনের উপরে নির্ভর করে। প্রাচীন শাস্ত্রজ্ঞেরা সমগ্র আকাশকে বারোটি অংশে ভাগ করেছেন। সেই ভাগের এক-একটিকে বলা হয় রাশি। সেই বারোটি রাশি অনুসারে রয়েছে বারোটি নক্ষত্র। সেই নক্ষত্রগুলির নাম অনুসরণে আমাদের বারোটি মাসের নামকরণ। যেমন, বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি। একটি রাশি থেকে অপর একটি রাশিতে সূর্যের যাওয়ার দিনটি হল ‘সংক্রান্তি’। সূর্যের এই রাশি বদলে সব মিলিয়ে সময় লাগে প্রায় তিরিশ দিন। মহালয়ায় তর্পণ হয় ভাদ্র সংক্রান্তি বা ষোড়শী সংক্রান্তিতে। এই সংক্রান্তির তিথি হয় অমাবস্যা। শুক্লা প্রতিপদ থেকে শুরু হয় দেবীপক্ষ। শুভেন্দুবাবু বলেন, “মল মাস হল অতিরিক্ত মাস। অনেকটা লিপ-ইয়ারের মতো। স্মৃতিশাস্ত্রে বলা হয় ‘অমাবস্যা দ্বয়োং যত্র, রবি সংক্রান্তি বর্জিতম্। মল মাসঃ স বিজ্ঞেয়’। চন্দ্র এবং সূর্যের গতির হিসাব মেলাতে একটা গোটা মাসকে বাদ দেওয়ার গাণিতিক প্রক্রিয়ার ফল হল মলমাস।”
বঙ্গবিবুধ জননী সভার পৌরোহিত্যের প্রশিক্ষক সুশান্ত ভট্টাচার্যও জানাচ্ছেন, হিন্দুধর্মের যাবতীয় কৃত্য হয় সূর্য এবং চাঁদের গতির উপরে নির্ভর করে। তবে সূর্যের সঙ্গে চাঁদের গতির ফারাক চোখে পড়ার মতো। ফলে সূর্য আর চাঁদের বেলায় হিসাবটা পাল্টে যায়। সৌরমাস মোটামুটি তিরিশ দিনে সম্পূর্ণ, অথচ চাঁদের সময় লাগে সাতাশ থেকে সাড়ে উনত্রিশ দিন। ফলে প্রতি মাসেই ওই আড়াই দিন অতিরিক্ত হতে থাকে। বছর শেষে যোগ করলে অতিরিক্ত দিনের সংখ্যা দাঁড়ায় গড়ে এগারো দিনে। সেই হিসাবে কম-বেশি তিন বছর অন্তর একটি করে মাস অতিরিক্ত হয়। সেই মাসে যাবতীয় উৎসব-অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়, যাতে পঞ্জিকার হিসাবের সুবিধা হয়। সুশান্তিবাবুর কথায়, “সেই মাসই মল মাস বা মলিন মাস বা অধিক মাস।”
স্মৃতিশাস্ত্র মতে মল মাস অশুভ, তাই শুভ কাজ নাস্তি। অথচ ভক্তিশাস্ত্র মতে মল মাসের মতো শুদ্ধ মাস আর হয় না। তাই উত্তর ভারতে বিশেষ করে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে এই মাস হল সাধন-ভজনের প্রকৃষ্ট সময়— বলছিলেন প্রবীণ ভাগবত পাঠক গোরাচাঁদ ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, “যেহেতু বাহ্যিক যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম বন্ধ, তাই ভগবৎ ভজনের এমন উপযুক্ত সময় আর হয় না।”সে সব তো সাধকের ব্যাপার। বাকি আমজনতার কাছে, ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ টাইমে এলেন অথচ দুগ্গা লেট’— এটুকুই যা কথা!