রক্তদাতা দশরথ দাস। নিজস্ব চিত্র
বিশেষ ভাবে সক্ষম দশরথ দাসের রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। মাত্র ১২ বছরের কিশোরী সুমাইয়া সুলতানার ঠিক ওই রক্তেরই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই রক্ত পরিচিত জনের কাছে মিলছিল না। শেষ পর্যন্ত খবর পেয়ে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া সুতির জামা গ্রাম থেকে ৩০ কিলোমিটার রাস্তা বাসে এসে দশরথ রক্ত দিয়ে যান জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে। সেই রক্ত গিয়েছে শমসেরগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি সুমাইয়ার কাছে। সুতির হাসানপুরের বাসিন্দা সুমাইয়ার অ্যাপেনডিক্সের অস্ত্রোপচার হয়েছে তার পর।
গত পাঁচ দিন ধরে হন্যে হয়ে ঘুরেও মেয়ের জন্য ‘ও নেগেটিভ’ রক্ত পাননি সুমাইয়ার বাবা পেশায় রাজমিস্ত্রি একবর আলি। অবশেষে অস্ত্রোপচারের পরে তিনি স্বস্তি পেয়েছেন।
দশরথ হাঁটতে পারেন না। পথ চলেন দুই হাত দিয়ে। সেই হাত দিয়েই ঝাড়খণ্ড লাগোয়া গ্রাম থেকে বেরিয়ে ৩০ কিলোমিটার পথ বাসে করে পেরিয়ে রক্ত দিয়ে যান দশরথ। দশরথ থাকেনও খুবই প্রত্যন্ত এলাকায়। সুতির কাশিমনগর পঞ্চায়েতের জামা গ্রামের বাসিন্দা দশরথ। কিন্তু সব প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে জঙ্গিপুর হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়ে বছর ৩৪ বয়সের দশরথ দিলেন তার রক্ত। এই নিয়ে ৪ বার রক্ত দিলেন দশরথ। প্রতিবারই কোনও না কোনও মুমূর্ষুর প্রয়োজনে এ ভাবেই ছুটে আসতে হয়েছে তাঁকে।
দশরথের বাড়িতে মা, বাবা ও চার ভাই। দশরথ মধ্যম। যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে রক্তদানের আর্তি পৌঁছেছিল দশরথের কাছে সেই সংগঠনের কর্ণধার কবির আলি বলছেন, “দশরথ ‘ও নেগেটিভ’ রক্তের ক্যারিয়ার। এই গ্রুপ সহজে মেলে না। ফলে দশরথের কখনও সাধারণ শিবিরে রক্ত নেওয়া হয় না। যখনই কোনও মুমূর্ষু কারও রক্তের প্রয়োজন পড়ে, আমরা যোগাযোগ করি দশরথের সঙ্গে। তাই সুতির হাসানপুরের কিশোরীর প্রয়োজন শুনে এ বারও সেই মতো শনিবার সকালে যোগাযোগ করা হয় তাঁর সঙ্গে। শোনা মাত্র এক কথায় রাজি। দুপুরেই গিয়ে হাজির হন জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে। রক্ত দিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে যায় বাড়ি।”
তিনি বলেন, “বিশেষ ভাবে সক্ষম দশরথ আমাদের গর্ব। অনেকেই এখনও রক্ত দিতে ভয় পায় এ জেলায়। দশরথকে দেখে এ বার অন্তত তাঁরা এগিয়ে আসবেন।”
কিশোরীর মামা সহিদুল ইসলাম বলছেন, “ও নেগেটিভ রক্তের জন্য খোঁজাখুঁজি কম করিনি। কিন্তু পাইনি। চিকিৎসকও বলছেন তাড়াতাড়ি অস্ত্রোপচার করা দরকার। কিন্তু রক্তের জন্য তা করা যাচ্ছিল না।” তাই শেষ পর্যন্ত সুতির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে সাহায্য চায় কিশোরীর পরিবার। ওই সংস্থার কাছেই দশরথের খোঁজ পান তারা।
দশরথ বলছেন, “উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত গ্রামের পাশের স্কুলেই পড়াশোনা করে আর এগোতে পারিনি। মায়ের কাছে শুনেছি আমার বয়স যখন বছর দেড়েক তখনই পা অসাড় হতে থাকে। বহু চেষ্টা হয়েছে চিকিৎসার। কিন্তু কাজে আসেনি। সেই থেকেই চলার এবং খাওয়ার ভরসা হাতই। ট্রাই সাইকেল একটি রয়েছে। কয়েকটি ছেলেমেয়ের গৃহশিক্ষকতা করে যা পাই সেটাই আমার আয়। ইচ্ছে থাকলেও কারও কোনও উপকারে আসতে পারি না। কিন্তু রক্তদান তো করাই যায়। সেই ভেবেই কারও প্রয়োজন পড়লে যাই।”মা বিশাখা দেবী ও বাবা রূপচাঁদ দাস অবশ্য বলছেন, “ছেলে বাড়ি থেকে বের হলে ভয় লাগে। কিন্তু রক্তদানের মতো ভাল কাজে বাধা দিই না।’’