এমনই পুজো ওঁদের। নিজস্ব চিত্র
পুজো সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ঠাকুর দেখা। বন্ধুবান্ধব-পরিজনদের সঙ্গে নতুন জামা-জুতো পরে হইহই করে এক মণ্ডপ থেকে অন্য মণ্ডপ ঘুরে বেড়ানো। অনেক সময় আবার ঠাকুর দেখতে বাস-ট্রেন ধরে চলে যাওয়া অন্য শহর বা গ্রামে।
উৎসবে ভেসে যে দিকে খুশি চলে যেতে ইচ্ছা হয় তাঁদেরও। মনটা ঘরে থাকতে চায় না বিশেষ করে দুর্গাপুজোর দিনগুলোয়। কিন্তু বাদ সাধে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা।
এঁদের মধ্যে কোনও কঠিন অসুস্থতার কারণে হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়েছেন। কেউ আবার জন্ম থেকেই হাঁটতে পারেন না। সর্বক্ষণের সঙ্গী ক্রাচ বা হুইলচেয়ার। আলোর মালায় সাজানো রাস্তা আর মণ্ডপে যখন মানুষের ঢল নামে তখন বাড়ির রোয়াক, জানালা বা বারান্দায় বসে এঁরা সেই আনন্দের আঁচ নেওয়ার চেষ্টা করেন। মনে-মনে শরিক হন ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখার আনন্দে। অনেকে আবার পুজোর কিছু দিন বাকি থাকতে হুইলচেয়ার বা ক্রাচ নিয়েই চলে যান পটুয়াপাড়ায় ঠাকুর গড়া দেখতে। চতুর্থী বা পঞ্চমীতে একটু ফাঁকায় ফাঁকায় পাড়ার মণ্ডপে প্রতিমা দর্শন করে আসেন।
শান্তিপুরের ৩ নম্বর গেটপাড়ার বাসিন্দা সোনা প্রামাণিক প্রায় ন’ বছর আগে কঠিন অসুখে পড়েন। পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে একটি পায়ের পাতা বাদ দিতে হয়। চলাফেরায় সঙ্গী হয় ক্রাচ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি বিশেষ তিন চাকার গাড়ি। পুজোর সময় সকাল বা দুপুরের দিকে যখন একটু ফাঁকা থাকে সেই সময়ে নিজের তিন চাকা গাড়িটি চালিয়ে বাড়ির কাছে মণ্ডপে চলে যান। বিকালের দিকে কয়েক জন বন্ধুকে ডেকে নেন ফোন করে, যাঁরা তাঁরই মতো প্রতিবন্ধকতার শিকার। তাঁদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব করেই পুজোর বেশির ভাগ সময় কেটে যায়।
সোনা প্রামাণিক বলেন, “পায়ের পাতা বাদ দেওয়ার পর থেকে আর ঠাকুর দেখতে বেরোনো হয় না। মণ্ডপে-মণ্ডপে পায়ে হেঁটে ঘোরা হয় না। ইচ্ছা করে খুবই। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায় এই সময়। বন্ধুদের সঙ্গে কত জায়গায় ঘুরতাম। এখন দূর থেকে অন্যদের দেখি। মাঝেমধ্যে কিছু সংস্থা আমাদের পুজো দেখাতে নিয়ে যায়।” শান্তিপুরের জমাদারপাড়ার বাসিন্দা সাধন বিশ্বাস ছোটবেলা থেকেই হাঁটতে পারেন না। তিন চাকার গাড়িতেই চলাফেরা তাঁর। বলেন, “গাড়ি নিয়ে তো আর ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা যায় না। ভিড়ের মধ্যেও সমস্যা হয়। তাই বাড়িতেই বারান্দায় বা জানালায় বসে রাস্তায় লোকজন, আলো দেখি। মন খারাপ হয়, কিন্তু কিছু করার তো নেই।’’
শান্তিপুর থানার ফুলিয়াপাড়ার বাসিন্দা সৌরভ কর্মকার সেরিব্রাল পালসি-আক্রান্ত। মেধাবী সৌরভ এ বারে কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিকে পাশ করে ভর্তি হয়েছে রানাঘাট কলেজে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে। হাঁটাচলা সে ভাবে করতে পারে না সে। বাবার সঙ্গে সাইকেলে বা বাইকে ঠাকুর দেখতে বের হয়। আবার অনেক সময় বাবা-মার সঙ্গে টোটোতে চেপেও ঠাকুর দেখতে যায়। তবে দিনের বেলায় যখন ভিড় কম থাকে তখনই ঠাকুর দেখে সে। অনেক মণ্ডপে সিঁড়ি থাকে, তখন কষ্ট হয়।
তবে দুর্গাপুজোর এই উৎসবমাখা পরিবেশ সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।