তালিকায় বাবাকে খুঁজে ফেরেন আব্দুল

গোটা জেলাজুড়েই এনআরসি নিয়ে বহু মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। লোকে এখন পরিচয়পত্র ঠিকঠাক করতে দিনরাত এক করে ফেলছে।

Advertisement

মনিরুল শেখ

কল্যাণী শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:২৯
Share:

প্রতীকী চিত্র।

দিন কয়েক আগের কথা। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আধিকারিক নিজের ঘরে বসে এক মনে কিছু কাগজের পাতা উল্টে যাচ্ছেন। একের পর এক পাতাতে চোখ রেখে এক মনে বলে চলেছেন, ‘‘সরকারের বেশ কিছু নির্দেশ দেখে মনে হচ্ছে, নাগরিকপঞ্জি হবেই। কারণ, এই প্রথমবার জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্ট্রেশনের কাগজে নাগরিকত্বের জায়গা রয়েছে। ওই রেজিস্ট্রেশন হওয়ার পর একটি পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। কিন্তু যাঁদের সন্দেহজন মনে হবে তাঁদের ওই কার্ড দেওয়া হবে না। তাঁদের সন্দেহজনক ভোটার বা নাগরিক বলা হবে। তখন তাঁদের নাগরিকত্ব প্রমান করতে হবে। এ সব নির্দেশ দেখে মনে হচ্ছে, এনআরসি হবেই।’’ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওই আধিকারিক বলে চলেন, ‘‘আমার পরিচয়পত্রের নথিতে বিস্তর বানান ভুল। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সে সব সংশোধন করতে হবে।’’

Advertisement

ওই আধিকারিক কোনও বিচ্ছিন্ন চরিত্র নন। গোটা জেলাজুড়েই এনআরসি নিয়ে বহু মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। লোকে এখন পরিচয়পত্র ঠিকঠাক করতে দিনরাত এক করে ফেলছে। মাঝ রাত থেকে ব্যাঙ্কের সামনে লম্বা লাইন পড়ছে আধার কার্ড বা রেশন কার্ডে থাকা ভুল সংশোধনের জন্য। ব্যাঙ্ক প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকের আবেদনপত্র গ্রহণ করে। কিন্তু কল্যাণী শহর ও আশপাশের এলাকা, হরিণঘাটা থেকেও শয়ে-শয়ে মানুষ এসে ভিড় করছেন সেন্ট্রাল পার্কের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সামনে। সবার মুখে একই কথা, ‘‘যে কোনও সময় এনআরসি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় সরকার। ফলে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র ঠিক না থাকলেই তো মুশকিল।’’

হরিণঘাটার বাসিন্দা আইজুল মণ্ডল, মিজানুর রহমানেরা জানাচ্ছেন, মূলত পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের জন্য বেশি চিন্তা। তাঁদের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্রের জন্যই ছুটোছুটি করা হচ্ছে। অনেকেরই বাবা-মা বা ঠাকুর্দার নামে জমি ছিল না। ফলে কয়েক দশক ধরে তাঁরা যে এ দেশেই বাস করছেন সেটা জমির দলিল দেখিয়ে প্রমাণ করতে পারছেন না। এঁদের বার্থ সার্টিফিকেটও নেই। ঘোর দুশ্চিন্তায় পড়েছে পরিবার। কেউ কলকাতায় ছুটছেন বহু আগের ভোটার তালিকায় নিজের নাম আছ কিনা তা খুঁজতে।

Advertisement

বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক মুসিয়ার আলি বলছেন, ‘‘সব থেকে বড় সমস্যা পদবি নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাবা-ছেলে- ঠার্কুদার পদবি আলাদা। এই অবস্থায় কী করণীয় তা অনেকেই বুঝতে পারছেন না। উদ্বেগে নাওয়াখাওয়া মাথায় উঠেছে।’’ কালীগঞ্জের বল্লভপাড়ার বাসিন্দা আব্দুল শেখ যেমন জানালেন, তাঁর বাবার নামে জমির কাগজ নেই। আর তাঁর নিজের জন্ম ১৯৭১ সালের পরে। ফলে তিনি বাবাকে ধরে প্রমাণ করতে পারবেন না যে, তাঁরা বহু দিন ধরেই এ দেশের নাগরিক। কলকাতায় ভোটার তালিকায় বাবার নাম রয়েছে সেই প্রমাণ আনতে এখন কলকাতা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন আব্দুল।

আসলে নাগরিকপঞ্জি এ বঙ্গে কবে হবে আর হলেই বা কত বছর ধরে এ দেশে বাস করলে নিজেকে এখানকার নাগরিক প্রমাণ করা যাবে সে সব নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এখনও রাজ্যসভায় পাশ হয়নি। ফলে এনআরসি হতে দেরি আছে। তার পরে ২০২০ সালের মাঝে শুরু হওয়ার কথা জনসংখ্যার রেজিস্ট্রেশন। তা চলবে ওই বছরের প্রায় শেষ পর্যন্ত। ওই প্রক্রিয়া শেষ হলেই তবেই তো কাউকে-কাউকে সন্দেহজনক ভোটার বলা হবে। কিন্তু মানুষের মন মানছে না। শুরু হয়েছে গণ-উদ্বেগ। আর এই উদ্বেগের সব থেকে বেশি শিকার জেলার ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা।

১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের একাধিক সংশোধনীর পর বলা হচ্ছে, পড়শি তিন মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে্র অমুসলিমেরা এ দেশে ছয় বছর ধরে থাকলেই মিলবে নাগরিকত্ব। এ নিয়ে জেলাজুড়ে বিজেপির সর্বাত্মক প্রচার চালাচ্ছে। ফলে ও পার বাংলা থেকে বিভিন্ন সময়ে আসা হিন্দুদের মধ্যে চিন্তা এখন অনেকটাই কমেছে। মুসলিমদের চিন্তা যাচ্ছে না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শেখ আব্দুল মতিন বলছেন, ‘‘বহু দিন ধরে এ দেশে বাস করা মানুষকে ফের লাইনে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, তাঁরা এখানকার নাগরিক। নাগরিকত্বের ধারণাই তো নেতিবাচক। নাগরিক বললেই রাষ্ট্রহীন, অধিকারহীন অনাগরিকের ধারণা চলে আসে। এনআরসি-র নামে মানুষকে ভয় দেখানো হচ্ছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে যে ভাবে মুসলিম ও অমুসলিমের বিভাজন করা হচ্ছে তা সমতার অধিকারের ধারণার বিরোধী।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement