খেলছে শুশুক। নিজস্ব চিত্র। কালীগঞ্জে দেখা মিলেছে ভোঁদড়েরও। ছবিটি গণেশ চৌধুরীর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
সূর্যের তেজ একটু কমতেই খাঁড়ির জলে ঘা মেরে আকাশের দিকে লাফিয়ে ওঠে ছোট্ট গাঙ্গেয় ডলফিন, দেশি কথায় যার নাম শুশুক। তার পিছু-পিছু আরও কয়েকটা। নরম সূর্যের আলো গায়ে মেখে জলের উপর খেলা করতে থাকে তারা। পিছনে তাদের মা শুশুক নিজের মতো চরে বেড়ায়। মাঝে-মাঝে মাছ ধরে এনে বাচ্চাদের খেতে দেয়। বাচ্চারা খেলতে খেলতেই মায়েদের কাছ থেকে মাছ খাওয়া, মাছ ধরা শিখতে থাকে।
সেই সময় পাড়ে দাঁড়িয়ে এক, দুই, তিন... করে শুশুকের সংখ্যা গুনতে থাকেন জীববৈচিত্র পর্ষদের ওয়ার্কিং গ্রপের সদস্য। খবর শুনে পৌঁছে যান নদিয়া জেলা জীববৈচিত্র ব্যবস্থাপনা সমিতির কো-অর্ডিনেটর।
দফতরের সমীক্ষা অনুযায়ী, কালীগঞ্জের চর বালিডাঙা দ্বীপের যেখানে অজয় নদ ভাগীরথীর সঙ্গে মিশেছে, সেখানে একাধিক খাঁড়ি তৈরি হয়েছে। বিকেল হতেই সেই খাঁড়ির শান্ত জলে কার্যত হুল্লোড় শুরু করে দেয় বেশ কয়েকটি গাঙ্গেয় ডলফিন ও তাদের কচিকাঁচা। খেলার পাশাপাশি তাদের শিকারও শেখায় মা ডলফিন। এমনটাই দাবি জেলা জীববৈচিত্র পর্ষদের। নেই-নেই করে সেখানে পরিণত ডলফিনের সংখ্যা প্রায় ১৮-২০টির মতো। এই বছরই সেখানে সাতটি শুশুক বাচ্চার জন্ম হয়েছে বলে দফতরের কর্তাদের দাবি।
শুধু তা-ই নয়, এত দিন পর শিশুদের পাঠ্যপুস্তক থেকে বাস্তবে দেখা দিয়েছে লুপ্ত হতে বসা ভোঁদড়। পর্ষদের দাবি, বর্তমানে ভোঁদড় অত্যন্ত বিরল প্রজাতির প্রাণী। তাদের দেখা মেলাই ভার। সেই ভোঁদড়েরই দেখা মিলেছে ওই চর বালিডাঙা দ্বীপে। সেখানে দু’টি পরিণত বয়সের ভোঁদড়ের সঙ্গে তাদের চারটি শিশু ভোঁদড়ের দেখা মিলেছে। সেই সঙ্গে দেখা গিয়েছে তাদের মানুষের মতো বাড়িও। সেখানে মানুষের বাড়ির মতোই রয়েছে একাধিক ঘর। কোনওটা নিজেদের জন্য, কোনওটা আবার শিশু সন্তানদের জন্য।
নদিয়া জেলা জীববৈচিত্র কো-অর্ডিনেটর শাশ্বতী রায় বলছেন, “এ ভাবে ভোঁদড়ের দেখা মেলা সত্যিই খুবই আনন্দের বিষয়। আমরা এদের সংরক্ষণের মাধ্যমে দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধির চেষ্টা করব।”
ইতিমধ্যেই ওই দ্বীপকে ‘বায়োডাইভার্সিটি হেরিটেজ সাইট’ হিসাবে তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। নদিয়া জেলায় জন জীববৈচিত্র নথি অনুযায়ী, নানা প্রজাতির প্রাণীর দেখা মিলেছে। তার মধ্যে অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়ে ভোঁদড়, গাঙ্গেয় ডলফিনের পাশাপাশি মেছো বিড়ালও ‘উদ্বেগজনক’ অবস্থায় আছে। জেলার বেশ কয়েকটি ব্লকে মেছো বিড়ালের দেখা মিললেও কর্তারা তাদের নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। কারণ, যেহেতু এরা মাছ খেয়ে ফেলে, তাই এদের ধরে মেরে ফেলেন স্থানীয়েরা। এমন ঘটনা সাম্প্রতিক কালে একাধিক বার ঘটেছে।
শাশ্বতী বলেন, “এদের বাঁচিয়ে রাখতে আলাদা করে প্রোজেক্ট নেওয়ার প্রয়োজন। তা না হলে এদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখাই কঠিন হবে।”
১৯৯২ সালে ‘কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি’-তে যোগ দেওয়া দেশগুলির মধ্যে অন্যতম ভারত। নিজের ভূখণ্ডে জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও সুষম ব্যবহারের জন্য ২০০২ সালে জীববৈচিত্র আইন প্রণয়ন করা হয়। আর সেই আইন প্রয়োগের উদ্দেশ্যে জাতীয় জীববৈচিত্র কর্তৃপক্ষ রাজ্য স্তরের পাশাপাশি আঞ্চলিক স্তরেও পুরসভা, গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে জীববৈচিত্র ব্যবস্থাপক সমিতি গঠন করে। পড়ুয়া ও পরিবেশ প্রেমীদের নিয়ে পঞ্চায়েত স্তরে গঠিত হয় ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’। ২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে জন জীববৈচিত্র নথি তৈরির কাজ।
সেখানে প্রাণীকূলের পাশাপাশি উদ্ভিদেরও নথি তৈরি করা হয়েছে। সেই নথি তৈরি করতে গিয়ে বেশ কিছু এমন দেশি প্রজাতির ধানের সন্ধান মিলেছে, যা লুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। সেই সমস্ত ধান বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করায় উদ্যোগী হবে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে।
জেলাশাসক শশাঙ্ক শেঠি বলেন, “আমরা লুপ্তপ্রায় প্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য একাধিক পদক্ষেপ করছি। সেই মতো পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ করা শুরু হয়েছে।”
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।