বিচার চেয়ে থানার গেটে বিক্ষোভ। নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। ছবি : সুদীপ ভট্টাচার্য।
খবরটা পেয়ে প্রথমেই ছুটে এসেছিলেন পুজো কমিটির সম্পাদক চন্দনা দাস।
তাঁদের মণ্ডপের সামনে পড়ে আছে একটি মেয়ের আধপোড়া দেহ। চন্দনা বলেন, “এসে দেখি, একটা পোড়া মৃতদেহ মণ্ডপের ভিতর রাস্তার উপরে চিত হয়ে পড়ে। মাথা থেকে হাঁটু পর্যন্ত পোড়া। হাত-পা ছড়ানো। পরনের সিন্থেটিক কাপড়ের জামা গলে গায়ে সেঁটে আছে। দূরে একটা সাদা-গোলাপি ছোপছোপ ছোট ব্যাগ পড়ে ছিল। তার ভিতরে একটা মোবাইল ফোন পেয়েছে পুলিশ।”
বুধবার সাতসকালে এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিল কৃষ্ণনগর স্টে়ডিয়ামের পিছনে রামকৃষ্ণ মিশন পাড়া। চন্দনা বলেন, “প্রথমেই মনে হয়েছিল, মেয়েটাকে ওরা নিশ্চয়ই ধর্ষণ করে খুন করেছে। এমন নিষ্ঠুর ভাবে কেউ কাউকে মারতে পারে?” এর পরেই তাঁদের দুর্গাপুজো কমিটি লক্ষ্মীপুজো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। পুজো কমিটির সদস্য সুমিতা পাল বলেন, “এক মায়ের কোল থেকে তাঁর লক্ষ্মীকে কেড়ে নেওয়া হল। আমরা কী করে লক্ষ্মীপুজো করব? এ ভাবে একের পর এক লক্ষ্মীর বিসর্জন হয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই মানতে পারছি না।”
কেন ঘটল এমন একটা ঘটনা?
পুলিশ ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, নিহত ওই দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীর ধর্ষণ-খুনের অভিযোগে যাকে ধরা হয়েছে, সেই যুবক গত সপ্তমীর দিন তার কর্মস্থল ওড়িশার কোরাপুট থেকে ফিরেছিল। দু’জনের সম্পর্ক ছিল। এর আগে এক বার ছাত্রীটি তার সঙ্গে চলেও গিয়েছিলেন। জগদ্ধাত্রী পুজোর পরে দু’জনের রেজিস্ট্রি-বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পুজোয় রাহুল ফেরার পরেই দু’জনের ঝগড়া হয়।
ছাত্রীটির মাসির দাবি, “অষ্টমীতে ঠাকুর দেখতে যাওয়া নিয়ে আমার বাড়িতে বসেই ওদের অশান্তি হয়। সেই সময় ছেলেটা রীতিমত হুমকি দিয়ে বলেছিল, ‘শেষ খেলা আমিই খেলব’। সেই খেলাটা খেলেই দিল।”
মঙ্গলবার রাহুলের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি ছাত্রীটি। রাত ১০টার আশপাশে তার ফেসবুক পোস্ট দেখতে পান কেউ কেউ। তাতে লেখা ছিল, “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।” ফলে এই ঘটনা আত্মহত্যা কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। কিন্তু এত জায়গা থাকতে নিজের বাড়ি থেকে গোটা শহর পেরিয়ে অন্য প্রান্তে পুলিশ সুপারের অফিসের নাকের ডগায় কেউ কেন আত্মহত্যা করতে আসবে, তা যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তা ছাড়া নিজের গায়ে আগুন দিয়ে কেউ আত্মহত্যা করতে চাইলে জ্বালানির পাত্র বা দেশলাইয়ের মতো যে সব সরঞ্জাম আশপাশে পড়ে থাকার কথা, পুলিশ এ দিন ঘটনাস্থল থেকে তেমন কিছু পায়নি। বরং ছড়িয়ে থাকা কয়েক গুছি চুল নিয়েই রহস্য দানা বেঁধেছে। মেয়েটির চুল কে, কেন কাটতে পারে, তার কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
কিন্তু উল্টো দিকে এটাও প্রশ্ন যে, ঠাকুর দেখতে যাওয়ার মতো সামান্য কারণ নিয়ে অশান্তির জেরে কেউ এমন করে খুন করতে পারে? বিশেষত যে সামান্য ঝগড়া তার পরেই মিটে গিয়েছিল বলে মেয়েটির পরিবার সূত্রেই জানা যাচ্ছে? প্রাথমিক ভাবে পুলিষ যে সন্দেহ করছে, অন্যত্র ধর্ষণ-খুন করে মণ্ডপে এনে প্রমাণ লোপাটের জন্য দেহ দগ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে, তা-ও কি এক জনের পক্ষে সম্ভব? তদন্তকারীদের মতে, এর পিছনে আরও কোনও গভীর বিষয় থাকতে পারে। ছাত্রীর ব্যাগে মেলা মোবাইল রহস্য ভেদে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র জোগাতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ। বিশেষ করে ফেসবুক পোস্টের রহস্য সমাধানে। কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার অমরনাথ কে বলেন, “কখন ওই পোস্ট করা হয়েছিল, মেয়েটি নিজেই তা করেছিল কি না, ওই সময়ে ফোন কার কাছে ছিল, সবটাই এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
যেখানে মৃতদেহ মিলেছে, সেটি পুলিশ সুপারের অফিসের একেবারে কাছে। বেশ নির্জন জায়গা। রাত একটু বাড়লে রাস্তায় মানুষের দেখা মেলে না। মেয়েটিকে যদি খুন করে এখানে এনে ফেলা হয়ে থাকে, তবে পুলিশের নাকের ডগায় যে এমন একটি জায়গা আছে, তা খুনির জানা ছিল। পরিকল্পনা করেই সব করা হয়েছে। তদন্তকারীদের মতে, তা-ই যদি হয়ে থাকে তবে কত জন এই অপরাধে যুক্ত ছিল, তারা কারা, সেগুলো খুঁজে বার করাই এই মুহূর্তে প্রধান কাজ।
এই ঘটনায় এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা সুনীল সরকার বলেন, “ভাবতে পারেন, পাড়ার ভিতরে এসে একটা মেয়েকে জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। কতটা সাহস বেড়েছে!” সিপিএমের নদিয়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এসএম সাদির কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী ডান্ডিয়া নাচছেন আর রাজ্যে একের পর এক ধর্ষণ-খুন হয়ে যাচ্ছে!” যদিও কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, দোষীদের কড়া শাস্তি হবে।