প্রাগৈতিহাসিক জনবসতির খোঁজ মিলেছিল সাগরদিঘির গন্ডগ্রাম হাটপাড়ায়। বর্তমানে আদিবাসী অধ্যুষিত ওই গ্রামে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে দফায় দফায় মনিগ্রামের চাঁদপাড়া লাগোয়া হাটপাড়ায় রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহালয় থেকে ৬ জনের একটি দল এই খনন কাজ চালান বিভাগীয় সুপারিটেন্ডেন্ট অমল রায়ের নেতৃত্বে। প্রায় মাস দুই ধরে চলে সে খনন কাজ। খননের ২ মিটার গভীরে হলুদাভ মৃত্তিকার মধ্যে থেকে একে একে উঠে আসে প্রস্তর খন্ডের সামগ্রী যাকে অমল রায় বর্ণনা করেছিলেন “এটা রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিশাল সাফল্যই শুধু নয়, এই সব নিদর্শন থেকে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের এক অজানা দিগন্ত উন্মোচিত হবে। প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে এক নতুন ভাবনা চিন্তার জন্ম দেবে। উৎসাহ জোগাবে গবেষণার ক্ষেত্রেও।”
রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব দফতরের এই সাফল্য দেখতে পুনের ডেকান কলেজ থেকে হাটপাড়ায় ছুটে আসেন দুই বিশেষজ্ঞ শরদ রাজগুরু ও ভাস্কর দেওতার। হাটপাড়ার মাটির গভীর স্তর ও প্রাপ্ত ২৪০টি প্রস্তর আয়ুধ পর্যবেক্ষণের পর তাঁরা জানিয়ে দেন “কয়েক সহস্রাব্দ আগেও হাটপাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এক উন্নততর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।”
কিন্তু হাটপাড়ার অতীত আজও অনাবিষ্কৃত।
সাগরদিঘির চাঁদপাড়া গ্রামটি গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের স্মৃতি বিজড়িত। এই গ্রামেই চাঁদ রায় নামে এক ব্রাহ্মণের কর্মচারী ছিলেন হোসেন শাহ। পরে গৌড়ের সুলতান হয়ে কৃতজ্ঞতাবশত পূর্বতন মালিক চাঁদ রায়কে এক আনা খাজনার বিনিময়ে এই গ্রামটি দান করেন।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় জানা যায়, “এই গ্রামে একটি বৃহদাকার পুরাতন মসজিদ রয়েছে এবং উহার চতুষ্পার্শে হোসেন শাহের রাজ্যকালের বহু শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে।’’ (বাংলার ইতিহাস, ২য় খণ্ড, নবম পরিচ্ছদ)।
কিন্তু সে মসজিদ আর অবশিষ্ট নেই।
ফাঁকা মাঠের মধ্যে একাধিক ঢিবি। কেউ বলেন পিরের দরগা, কেউ বলেন হোসেন শাহের রাজবাড়ি। অসংখ্য দিঘি রয়েছে সেখানে। টাঁকশাল, হাওয়াখানা, রানিপুকুর নামে ডাকা হয় সেই সব দিঘিকে। পিরতলার প্রায় ২০০ মিটার দূরে চাঁদ রায়ের বসতভিটের ঢিবিতেই হাটপাড়ায় প্রথম শুরু হয় সেই খননের কাজ। ৪ ফুট গর্ত খুঁড়তেই প্রচুর পরিমাণে পোড়া মাটির লাল ও কালো পাত্রের ভগ্নাবশেষ মেলে। এলাকায় বহু বাড়িতেই খোঁজ করে মেলে বিভিন্ন সময়ে এখানকার মাটি খুঁড়ে কুড়িয়ে পাওয়া কয়েকটি মুদ্রাও। তবে সবটাই ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দের হোসেন শাহের আমলের ও মধ্যযুগের।
তবু প্রাচীন সভ্যতার খোঁজ ছিল। খননের গভীরতা ২ মিটার ছাড়াতেই একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে প্রাচীন সভ্যতার চমকপ্রদ নিদর্শন। ব্লেড, স্ক্রাপার, লুনেট জাতীয় নানা ধরনের পাথরের ধারালো অস্ত্র যা এত বছর পরেও যথেষ্ট ক্ষুরধার সম্বলিত। সবগুলিই চ্যাট, অ্যাগেট, চ্যালসেডোনি জাতীয় পাথরের। এমন পাথর পশ্চিম ভারতের বহু এলাকায় দেখা যায়। এমনকি পুরুলিয়া, বাঁকুড়াতেও তা মেলে। কিন্তু মুর্শিদাবাদে এভাবে অজস্র উন্নত ধারালো মসৃণ প্রস্তর অস্ত্র বা আয়ুধ নিঃসন্দেহে উন্নত সভ্যতার চিহ্ন।