আর গাড়ি চালাতে পারব তো!

জানি না আর কোনও দিন গাড়ির স্টিয়ারিংটা ধরতে পারব কি না! তবে বিশ্বাস করুন, আমার ভুলে কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটেনি। রাস্তা ফাঁকা ছিল। আমিও প্রায় ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। উল্টো দিক দিয়ে ট্রাক আসছিল। প্রথমে ডিপার করলাম। ট্রাকের চালকও ডিপার করল।

Advertisement

মানব মণ্ডল (গাড়ির চালক)

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৫ ০০:৩৯
Share:

জানি না আর কোনও দিন গাড়ির স্টিয়ারিংটা ধরতে পারব কি না! তবে বিশ্বাস করুন, আমার ভুলে কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটেনি। রাস্তা ফাঁকা ছিল। আমিও প্রায় ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। উল্টো দিক দিয়ে ট্রাক আসছিল। প্রথমে ডিপার করলাম। ট্রাকের চালকও ডিপার করল।

Advertisement

ভাবলাম, তাহলে বোধহয় সব কিছুই ঠিকঠাক আছে। কারণ রাতে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে এটাই তো দস্তুর। কিন্তু কাছাকাছি আসতেই ট্রাকটির আলোর জোর আচমকা বেড়ে গেল। সেই আলোর ছটা এসে পড়ল সোজা আমার চোখের উপর। আবার ট্রাকটিও আমাকে কোনও জায়গা না দিয়ে একেবারে গায়ের কাছে চলে এল। দুর্ঘটনা এড়াতে মুহূর্তে আমার গাড়িটাকে রাস্তার পাশে নামাতেই দেখি মাত্র ২০-২৫ হাত দূরে বিশাল গাছটা।

ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি, এক দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে গিয়ে আরও বড় বিপদের মুখে পড়ে গিয়েছে। কিন্তু ওই মুহূর্তে এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে, কী করা উচিত সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। মাথাও কোনও কাজ করছিল না। ওই অবস্থায় গাড়িটাকে আবার ডান দিকে রাস্তায় তোলার জন্য জোরে স্টিয়ারিং ঘোরালাম। তাতে গাড়িটা কিছুটা ডান দিকে ঘুরলেও বিশেষ কাজ হল না। সেকেন্ডের মধ্যে গাড়িটা গিয়ে ধাক্কা মারল ওই গাছটার গায়ে। তারপরেই বিকট একটা শব্দ।
হাতে, মাথায় জোর আঘাত পেলাম। বুঝতে পারলাম, বড়সড় একটা বিপদ ঘটে গিয়েছে।

Advertisement

সময় নষ্ট না করে গাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে সোজা পিছনে চলে যাই। সেখানেই পাঁচ জন ঘুমিয়েছিল। সকলকেই ধাক্কা দিয়ে ডাকতে থাকি। কিন্তু কেউই সাড়া দিল না। গাড়ির ভিতরে তাকিয়ে দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে গেল। কিন্তু সেই অবস্থাতেই কোনও মতে সামনের দিকে গিয়ে গাড়ির বাঁ দিকের দরজাটা খুলতেই প্রশান্তকাকা ধপ করে নীচে পড়ে গেল। তখন আর আমার বুঝতে কিছুই বাকি নেই। কার্তিকদাকে বের করতে গিয়ে দেখি তার পা আটকে আছে। টানাটানি করেও তাকে বের করতে পারলাম না। ততক্ষণে দু-একজন করে গ্রামের লোকজন এসে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। তারাও এমন অবস্থা দেখে প্রথমে ঘাবড়ে যায়। এরই মধ্যে পুলিশের গাড়ি চলে আসে। সকলে মিলে চেষ্টা করে কার্তিকদাকে বের করা হল। সেইসময় কৃষ্ণনগরের দিকে একটা গাড়ি যাচ্ছিল। পুলিশ সেটাকে থামিয়ে আমাদের দু’জনকে তাতে তুলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল। তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে ছ’জনের কেউই আর বেঁচে নেই। চোখটা কিছুতেই বন্ধ করতে পারছি না। চোখ বন্ধ করলেই পুরো দৃশ্যটা ভেসে উঠছে।

আমি আগে তেহট্টে একটি লগ্নিসংস্থার অফিসে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করতাম। বছর খানেক আগে শাখাটা বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে খেতের কাজ শুরু করি। ছয়-সাত বছর আগে গাড়ি চালানো শিখেছিলাম। বছর খানেক আগে পরীক্ষা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সও বের করি। মাস চারেক আগে আমার শ্বশুরমশাই গাড়িটা কিনলেন। তারপর থেকে আমিই ওই গাড়িটা চালাতাম। বিভিন্ন জায়গায় সব্জি নিয়ে যেতাম।

বাদকুল্লা থেকে মৃত্যু সংবাদটা আসার পরেই আমরা নিজেদের ওই গাড়িতে করেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি যে, আমাদের জন্য কী ভয়ঙ্কর মুহূর্ত অপেক্ষা করে আছে। এরপরে আর গাড়ি চালাতে পারব তো!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement