দুর্ঘটনার পরেও রেষারেষি চলছেই

বদলায়নি কিছুই। সাকুল্যে দেড় দিন হবে, ইসলামপুর মোড়ে ভাঙা ডালের মতো বাসের জানলা থেকে খসে পড়েছিল যাত্রীর ডান হাত। দু’টি একই রুটের বেসরকারি বাসের সেই রেষারেষি দেখে মঙ্গলবারও অবাক হয়ে গিয়েছিল সেই ইসলামপুর।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০১:০৯
Share:

বদলায়নি কিছুই।

Advertisement

সাকুল্যে দেড় দিন হবে, ইসলামপুর মোড়ে ভাঙা ডালের মতো বাসের জানলা থেকে খসে পড়েছিল যাত্রীর ডান হাত। দু’টি একই রুটের বেসরকারি বাসের সেই রেষারেষি দেখে মঙ্গলবারও অবাক হয়ে গিয়েছিল সেই ইসলামপুর। স্থানীয় এক ফল বিক্রেতা বলছিলেন, ‘‘ওদের কী একটুও লাজ লজ্জা নেই, আজ আবার সেই রেষারেষি করছিল!’’ তেরিয়া হয়ে জনতা তাড়া করেন বাস চালককে। তবে ঘটনা খুব বেশি দূর গড়য়ানি।

ইসলামপুরের মতো এ দিনও, ডোমকল মহকুমার শেখপাড়া মোড়, রানিনগর, ডোমকল, জলঙ্গি মোড়ে রেষারেষি চোখ এড়ায়নি। কোন বাস কাকে ‘ওভারটেক’ করে আগে যাবে? পুলিশের হিসাবে, স্রেফ সেই ‘প্রতিযোগিতা’য় গত তিন বছরে মুর্শিদাবাদ জেলায় ৪৫৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে আহতের সংখ্যা তিনশোর বেশি। মৃতের সংখ্যা শতাধিক।

Advertisement

হিসেব দিচ্ছে বটে, তবে সে ব্যাপারে পুলিশের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। যা নিয়ে অবশ্য মাথাব্যাথা নেই পরিবহণ দফতরেরও। মুর্শিদাবাদ আঞ্চলিক পরিবহন আধিকারিক (আরটিও) চিরন্তন প্রামাণিক বলছেন, ‘‘আরটিও দফতর থেকে মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হয় ঠিকই। তবে ওই পর্যন্তই।’’ তিনি জানান, জেলায় এত গুলি রুট, আর তা দেখভাল করার জন্য আরটিও দফতরে রয়েছেন মাত্র দু’জন ইন্সপেক্টর। ফলে প্রয়োজন মতো অভিযান চালানো সম্ভব হয় না তাঁদের। জেলার বেসরকারি বাসের মালিক সমিতি আর শ্রমিক সমিতি— দু’পক্ষই রেষারেষির জন্য রাস্তার সংকীর্ণতা ও যানজটজনিত কারণকেও দায়ি করছেন।

মুর্শিদাবাদ জেলার বেসরকারি যাত্রীবাহী বাসের মালিক সমিতির সম্পাদক তপন অধিকারী এবং বাস-কর্মী সংগঠনের জেলা সম্পাদক জয়দেব মণ্ডল আবার, মমনে করেন, প্রথমত, ক্রমাগত জবরদখলের ফলে রাজ্যসড়ক এখন সরু সুতোর মতো আকার নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এক দিকে রাস্তার চওড়া কমছে ও অন্যদিকে যানবাহনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। তৃতীয়ত, রুটের সময় সূচি অনুসরে একটি বাসের সঙ্গে অন্য বাসের চলাচলের সময়ের ব্যবধান মাত্র ৫-৭ মিনিট। তার ফলে বাসগুলির প্রতিযোগিতা বাড়ছে। দুর্ঘটনার কারণ এগুলোই।

কিন্তু নিত্যযাত্রীদের অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। নিত্যযাত্রীদের দাবি, বহরমপুর ঢোকার আগে ও কান্দি বাসস্ট্যান্ডে যাত্রী নেওয়ার জন্য পরি কি মরি ভাবে বাস গুলি যাতায়াত করে। কান্দির নিত্যযাত্রী পেশায় শিক্ষক পলাশ ঘোষ বলেন, “এমন ভাবে বাস গুলি চলে তা নিয়ে মাঝেমধ্যেই বাসের চালক ও কর্মীদের সঙ্গে বিবাদ বেধে যায়। ধীরে চলে যে সময়টা নষ্ট করে, সেই সময়টা গতি বাড়িয়ে বাস চালালে এই সমস্যা থাকে না।’’

কথাটি খানিক সত্যিও বটে। শবাসকর্মী সংগঠনের এক নেতা বলেন, ‘‘বেশি যাত্রী তুলতে পারলে মালিকের মুখ ঝামটা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। সেই কারণে পিছনের বাস আগের বাসকে টপকাতে চেয়ে গতি বাড়িয়ে দেয়। তখনই ঘটে দুর্ঘটনা।’’ লালগোলার নেতাজি মোড়ে, ভগবানগোলার নেতাজি মোড়ে, কান্দির জীবন্তি মোড়, বড়ঞার কুলির মোড়, সালার, ভরতপুর, বেলডাঙার বড়ুয়া মোড়ের সেই রেষারেষিরই শিকার হ পথ চলতি মানুষ। এই রেষারেষির জেরেই সাম্প্রতিককালে রঘুনাথগঞ্জের ফুলতলায় লালখান্দিয়ার গ্রামের মা ও ছেলের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। রঘুনাথগঞ্জের শ্রীকান্তবাটি হাইস্কুলের ঠিক সামনেই দুটি বাসের রেষারেষিতে প্রাণ গিয়েছিল নিস্তার গ্রামের বাসিন্দা এক স্কুল ছাত্রের। দুটি ঘটনাতেই জনতার রোষে আগুন ধরেছিল বাসে। রঘুনাথগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে ঢোকার মুখেই স্কুল ফেরতা খরিবোনা গ্রামের ছাত্রীর প্রাণ গিয়েছিল বাসের ধাক্কায়। কে আগে উমরপুর মোড়ে পৌঁছবে তাই নিয়ে তালাই মোড়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে সম্প্রতি দুটি বাসের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হন ৫ জন যাত্রী। একই ভাবে রেষারেষির ঘটনা ঘটে কান্দি-সালার রুটে।

পুলিশ কী করছে? মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলছেন, ‘‘আমরা তো থানায় থানায় নির্দেশ পাঠিয়েছি, কঠোর হাতে বাসের এই রেষারেষি বন্ধ করতে হবে।’’

কিন্তু কে শুনছে তাঁর কথা?

লুৎফা বিবির হারানো হাত যেন সে প্রশ্নই করছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement