রানাঘাটের কনভেন্ট স্কুলে ডাকাতি করতে এসে দুষ্কৃতীদের প্রথম জিজ্ঞাসা ছিল, সব চেয়ে বয়স্ক সন্ন্যাসিনী কে? সন্ধান মিলতেই বৃদ্ধ মাদার সুপিরিয়রকে একটি ঘরে আরও চার জনের সঙ্গে আটকে রাখে তারা। ডাকাতি করে চলে যাওয়ার আগে তাঁকে অন্য একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে এক দুষ্কৃতী।
রানাঘাটের ঘটনার তদন্তে নেমে এমন তথ্য হাতে আসার পরে খানিকটা বিস্মিত সিআইডি-র তদন্তকারীরা। অন্যদের বাদ দিয়ে ৭৪ বছর বয়সী মাদার সুপিরিয়রকেই কেন আলাদা করে বেছে নিয়ে ধর্ষণ করা হল, সেটাই তাঁদের প্রশ্ন। তদন্তকারীদের বক্তব্য, নিছক ডাকাতির উদ্দেশ্যে যে দুষ্কৃতীরা আসেনি, সেটা এই যৌন নির্যাতনের ঘটনা থেকে স্পষ্ট। এর পিছনে ওই বৃদ্ধ সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে কারও পুরনো কোনও শত্রুতার জের রয়েছে কি না, খতিয়ে দেখছেন তাঁরা।
ছাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার ও কাজে গাফিলতির অভিযোগে কয়েক জন নিরাপত্তা রক্ষীকে বরখাস্ত করার পরে স্কুলে হুমকি ফোন এসেছিল বলে স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি। তার মধ্যে কয়েক বার হিন্দিতে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এ সব এখানে চলবে না। এই ঘটনার কথা পুলিশকে জানানো হয়েছিল বলেই দাবি স্কুল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু চাকরি যাওয়ার রাগে কোনও প্রাক্তন নিরাপত্তা রক্ষীর ইন্ধনেই কি স্কুলে ডাকাতি এবং মাদার সুপিরিয়রের উপরে অত্যাচার? স্কুল সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রশাসনিক যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার স্কুলের অধ্যক্ষের। তাঁর নির্দেশেই ওই নিরাপত্তা রক্ষীদের বরখাস্ত করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে মাদার সুপিরিয়রের কোনও ভূমিকাই নেই। সে ক্ষেত্রে ওই বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীর উপরেই কেন অত্যাচার চালানো হল, সেই উত্তর এখনও সিআইডি-র অধরা।
শুক্রবার রাতের ঘটনা পরম্পরা খতিয়ে দেখে তদন্তকারীদের এটাও ধারণা হয়েছে যে, স্কুল ও তার বাসিন্দাদের সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর দুষ্কৃতীদের কাছে ছিল। স্কুলে নগদ টাকা মজুত থাকার খবরের পাশাপাশি স্কুলবাড়ির কোথায় কোথায় সিসিটিভি রয়েছে, এটাও তারা জানত। তাই স্কুলে ঢুকে প্রথমেই সিসিটিভিগুলি ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু ঘটনাচক্রে তাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়নি। ফলে সাত জন দুষ্কৃতীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। সিআইডি গোয়েন্দাদের বক্তব্য, এদের মধ্যে এক জন স্থানীয় দুষ্কৃতী। বাকিরা বহিরাগত ভাড়াটে দুষ্কৃতী বলেই সন্দেহ। কিন্তু ওই স্থানীয় দুষ্কৃতীর সঙ্গে অতীতে স্কুলের কোনও যোগ ছিল কি না, সে সম্পর্কে গোয়েন্দাদের তরফে কিছুই জানানো হয়নি। ফলে স্কুলের ভিতরের খবর ওই দুষ্কৃতীই সরবরাহ করেছিল নাকি অন্য কেউ, সে ব্যাপারে ধোঁয়াশা কাটেনি।
সিআইডি-র তদন্তকারীদের অন্য একটি অংশ আবার বলছেন, স্কুল সম্পর্কে দুষ্কৃতীদের খবর যে সরবরাহ করেছিল, সে নিজে স্কুলের ভিতরে ঢোকেনি। বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। ওই গোয়েন্দাদের মতে, শুক্রবার রাত একটা নাগাদ দুষ্কৃতীরা স্কুলের বাইরে জড়ো হয়। ভিতরে কেউ জেগে আছেন কি না তা বুঝতে প্রথমে স্কুলে ইট ছোড়া হয়। সাড়াশব্দ না-পেয়ে দুষ্কৃতী দলটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে পাঁচিল টপকে স্কুলে ঢোকে। ভিতরে গিয়ে তারা প্রথমে চড়াও হয় দারোয়ানের ঘরে। তিনি তখন ঘুমোচ্ছিলেন। দারোয়ানকে বেঁধে ফেলে তাঁকে নিয়েই স্কুলের ভিতরে ঢোকে দুষ্কৃতীরা। স্কুলে তখন মাদার সুপিরিয়র ও অধ্যক্ষ-সহ মোট চার জন সন্ন্যাসিনী ছিলেন। সব চেয়ে বয়স্ক সন্ন্যাসিনী সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার পরে সবাইকে একটি ঘরে আটকে রেখে আলমারি ভেঙে দুষ্কৃতীরা টাকা লুঠ করে। রেফ্রিজারেটার খুলে খাবার খায়। সব শেষে বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণ করার পরে ভোর পাঁচটা নাগাদ স্কুল থেকে বেরিয়ে রেল স্টেশনের দিকে চলে যায় তারা। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “স্কুল থেকে স্টেশনের রাস্তায় মাফলার, খেলনা পিস্তল মিলেছে। তা থেকেই দুষ্কৃতীদের গতিপথ স্পষ্ট হয়েছে।”
সিআইডি সূত্রে বলা হচ্ছে, দীর্ঘক্ষণ বন্ধ ঘরে আটক থাকার কারণে এক সন্ন্যাসিনী শ্বাসকষ্টের কথা বলেছিলেন। তখন তাঁকে বাইরে বেরোতে দেয় দুষ্কৃতীরা। কোনও কোনও তদন্তকারীর প্রশ্ন, বাইরে বেরনোর পরেও তিনি কেন চিৎকার করলেন না? তবে চিৎকার করে আশপাশের বাসিন্দাদের সতর্ক করার মতো পরিস্থিতি ছিল কি না, সে কাজ করতে গেলে তাঁর প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা ছিল কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
শুক্রবার রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত প্রায় চার ঘণ্টা স্কুলে কাটিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। এত দীর্ঘক্ষণ ধরে ঘটনাস্থলে থাকার কারণ কী? তদন্তকারীদের একাংশের বক্তব্য, দুষ্কৃতীদের লক্ষ্যই ছিল ভোরের ট্রেন ধরে এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া। তারা যে সময়ে স্কুল থেকে বেরিয়েছিল, তার কাছাকাছি সময়েই কলকাতা যাওয়ার একটি ট্রেন রয়েছে। নদিয়া জেলার অনেক সব্জিবিক্রেতা ওই ট্রেনে চেপে কলকাতায় আসেন। তাই ট্রেনটিতে ভালই ভিড় হয়। দুষ্কৃতীরা রীতিমতো পরিকল্পনা করেই ওই ট্রেনের ভিড়ে মিশে গিয়েছে বলে তদন্তকারীদের ধারণা। তাঁদের বক্তব্য, সন্ন্যাসিনীরা যাতে স্থানীয় লোকজন ও পুলিশকে সতর্ক করার জন্য যথেষ্ট সময় না পান, সে জন্যই একেবারে শেষ মুহূর্তে স্কুল ছেড়েছিল দুষ্কৃতীরা। যাওয়ার আগে স্কুলের গেটে বাইরে থেকে তালাও দিয়ে যায় তারা। অনেক পরে যে তালা ভেঙে সন্ন্যাসিনীদের উদ্ধার করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এত কিছু জানার পরেও এ দিন সিআইডি চার অভিযুক্তের ছবি ও তিন জনের স্কেচ প্রকাশ ছাড়া বিশেষ কিছুই করতে পারেনি। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলছেন, “দুষ্কৃতীদের দু’জন বাংলায় এবং কয়েক জন হিন্দিতে কথা বলছিল বলে জানা গিয়েছে। যারা বাংলায় কথা বলছিল, তাদের উচ্চারণে পূর্ববঙ্গের টান রয়েছে।” তদন্তকারীদের একটি সূত্র বলছে, ওই দুষ্কৃতীরা নদিয়া এলাকায় এর আগেও দুষ্কর্ম করেছে। বাংলাদেশেও তাদের গতিবিধি রয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, অপরাধ করে সীমান্ত পেরিয়ে যেতে পারে দুষ্কৃতীরা। তাই ইতিমধ্যেই সীমান্তবর্তী এলাকায় বিশেষ সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলছেন, “এ ব্যাপারে বিএসএফ-কে সতর্ক করা হয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে বিশেষ তল্লাশি চলছে।” অভিযুক্তদের ছবি কলকাতা-সহ সব জেলা পুলিশকে পাঠানো হয়েছে। যদিও সিআইডি-র একটি সূত্রের খবর, তিন জন দুষ্কৃতী ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছে। রানাঘাটে এখন শিবির করে বসে রয়েছেন এডিজি (সিআইডি) রাজীব কুমার। দুষ্কৃতীদের ধরতে সিআইডির চারটি বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে।
সোমবার রানাঘাটের ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে দেখা করেন রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি। পরে তিনি বলেন, “তদন্ত চলছে। সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” নদিয়ার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “দশ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এখনও পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে আমরা জানতে পেরেছি ওই ঘটনার সঙ্গে ৭-৮ জন জড়িত রয়েছে। বেশ কিছু সূত্র ধরেই তদন্ত এগোচ্ছে।”