মুর্শিদাবাদ জেলার কোনও স্কুলে মিডডে মিলের রান্না ও খাওয়া হয় পৃথক স্থানে— এমনটা বিশ্বাস করতে নারাজ জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ।
মিনি ভারতবর্ষ তাঁদের শহর। ওই আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন ঐতিহাসিক শহর জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের লোকজন। যুগ যুগ ধরে ভাগীরথী পাড়ের ছোট্ট যমজ শহর জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জে পাশাপাশি বাস করেন শিখ, জৈন, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন। ধর্ম বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে মুর্শিদাবাদ জেলার কোনও স্কুলে মিডডে মিলের রান্না ও খাওয়া হয় পৃথক স্থানে— এমনটা বিশ্বাস করতে নারাজ জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ।
বিশ্বাস করবেনই বা কী করে? গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে স্থানীয় প্রেমকুমারী বালিকা বিদ্যালয়ে জিয়াগঞ্জ-পুরসভার বর্তমান ইঞ্জিনিয়র আতাউর রহমানের সহপাঠী ছিলেন এখন পারাদ্বীপের ইঞ্জিনিয়র পার্থপ্রতিম সাহা ও জয়ন্ত সরকার। তখন স্কুলের টিফিনে পাউরুটি দেওয়া হত। আতাউর বলেন, ‘‘টিফিনের পাউরুটি পার্থপ্রতিম, জয়ন্ত আর আমি নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করে খেতাম। সরস্বতী পুজোর ভোজে ও বার্ষিক ক্রীড়ার দিনে স্কুল থেকে আলু-বাঁধাকপির ডালনা ও লুচি খেতে দিত। অন্যদের সরিয়ে দিয়ে আমরা তিন জনে পাশাপাশি বসে পাত পেড়ে তারিয়ে তারিয়ে খেতাম।’’
জিয়াগঞ্জের পুজোপাঠের পরিচিত পুরোহিত ৬৫ বছর নাডুগোপাল চট্টোপাধ্যায় ৩৭ বছরে ধরে স্থানীয় মরিচাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘শিখ, জৈন, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিশুরা পাশাপাশি বসে যুগ যুগ ধরে পরমতৃপ্তিতে স্কুলের মিডডে মিল খেয়েছে। এখনও তাই। জাতপাতের প্রশ্ন কখনও ওঠেনি।’’
আমাইপাড়া উদ্বাস্তু বিদ্যাপীঠের অবসরপ্রাপ্ত সহকারি প্রধানশিক্ষক, ৭১ বছরের সমীর ঘোষের শৈশবের ঘনিষ্ঠ সহপাঠী ছিলেন রাজিবুদ্দিন শেখ, শামসুল হক, অশোক চৌধুরী ও জিতেন সাহা। সমীর বলেন, ‘‘তখন শুক্রবার স্কুল থেকে পেনখেজুর ও গুঁড়ো দুধ দিত। আমরা পাঁচ বন্ধু ভাগাভাগি করে খেতাম।’’ অনেক সময় বাড়ি থেকে থালা আনতে ভুলে যেতেন নীহারুল ইসলাম। সাগরদিঘি থানার হড়হড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহপাঠী শিবু মারাণ্ডির খাওয়া হয়ে গেলে তার থালা চেয়ে নিয়ে খেতেন নীহারুল। লালগোলার এমএসকের শিক্ষক নীহারুল বলেন, ‘‘মামাবাড়িতে থেকে হড়হড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় কে আদিবাসী? কে হিন্দু? কে মুসলমান? এমন কথা কখনও মনে জাগেনি।’’
কারণ, সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। মুর্শিদাবাদ পর্যটক সহায়তা কেন্দ্রের সম্পাদক স্বপনকুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘একই জমিতে দুর্গাপুজো ও ইদমিলনী অনুষ্ঠান করার জন্য দক্ষিণ দরওয়াজার সামনে ১৯৫৯ সালে জমিদান করেন নবাব বাহাদুর ওয়াসিফ আলি মির্জা, ঐতিহাসিক কিরীটেশ্বরী মন্দির আছে মুসলমানের দানের জমিতে, হিন্দু পরিবারের সদস্যরা আজও উপোস করে মহরমের অশৌচ পালন করেন।’’ নবাবি জেলার সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের ইতিহ্যের তালিকা আরও অনেক বড়।
সেখানে রামডোবার স্কুলে দুই গ্রামের এমন অস্পৃশ্যতা ভাবলেই শিউরে উঠছে ঐতিহ্যের ইতিহাস।