মুর্শিদাবাদের রাজানগর গ্রামে চলছে সৌহার্দ্য ভোজের রান্না।
ডালের বালতি নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন দেখে হাঁক পড়ল, ‘‘কই গো ওঁর পাতে তো এক ছিটে দিয়েই চলে যাচ্ছ। মানুষটাকে খিচুড়ি দাও দু’ হাতা!’’
হইহই করে উঠছেন যিনি, তাঁকে চেনেন? সিপিএম নেতা সুশান্তবাবুর স্ত্রী রেখাদেবী।
আর সলজ্জ মুখে যিনি বলছেন, ‘‘না না বউদি, আর খেতে পারব নাকো, দিও না জোর করে’’, তিনি? চিনে রাখুন, তৃণমূল নেতা প্রণয়বাবুর স্ত্রী গৌরীদেবী।
মেলামেশাটা এমনই। আর ওই যে দু’হাতা খিচুড়ির জন্য মরিয়া হাঁক— জেনে রাখুন ওটা নিছক একটা সেতু। গ্রামীণ জীবনে দুই পড়শির সম্পর্ক বেঁধে রাখার মরিয়া একটা সাঁকো।
দলাদলির দূরত্বটুকু মুছে একে বারে বুকে বুক লাগিয়ে বিজয়ার আটপৌরে পড়শি যাপনকে বেঁধে রাখার একটা কুলীন ট্রাডিশন। ।
হ্যাঁ, রঘুনাথগঞ্জের রাজানগরের সেই প্রথাটা এ যাবতও অটুট, আজও। পুজো-অন্তে পুরনো আকচাআকচিতে নতুন করে জড়িয়ে পড়ার আগে গ্রামের বিজয়া যেন এমনই সম্মেলন। যেখানে কংগ্রেস-তৃণমূল কিংবা সিপিএমের সেই পুরনো দাপট, যা দিন কয়েক আগেওদুই প্রতিবেশীর মাঝে অদৃশ্য পাঁচিল তুলে দিয়েছিল, নবমীর রাত পোহাতেই তা ভেঙে-গলে চুড়মার।
রবিবার সকাল থেকেই তাই গ্রামে জ্বলেছে সাত-সাতটি উনুন। খিচুড়ি, চাটনি আর পাঁচ মিশেলি তরকারি।
যে খিচুড়ির কড়াইশুটি তুলে দিয়েছেন কংগ্রেস ঘরণি আর কেতের সব ফুলকপির মাথা মুড়িয়ে নিয়ে এসেছেন যিনি তিনি ঘোর তৃণমূল পরিবারের। আঁজলা ভরা টমেটো নিয়ে সাত সকালেই ছুটে এসে সিপিএম পরিবারের মহিলা বলছেন, ‘‘ও দিদি এ বার সকলের জন্য তো চা বসাতে হবে, আপনার কর্তা তো চিনি ছাড়া নাকি!’’ যাঁকে বলছেন, তিনি এলাকার তাবড় তৃণমূল নেতার স্ত্রী।
তৃণমূলের বুথ সভাপতি প্রণয় দাস আর কংগ্রেসের বুথ সভাপতি অকৃতদার কৃষ্ণধন দাসকেও দেখা যাচ্ছে এ-ওর পিঠে হাত দিয়ে খিচুড়িতে কিঞ্চিৎ বেশি ঝাল দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে যেতে আর যা দেকে সিপিএমের লোকাল কমিটির সম্পাদক সত্তরোর্ধ সুশান্ত দাস চিমটি কেটে যাচ্ছেন, ‘‘তা হলে আমাকে বাদ দিয়েই রান্না হবে নাকি !’’
একান্ন বছর ধরে এটাই রাজানগরের নিয়ম।
নেপথ্য গল্পটা এ বারও বদলায়নি। বিজয়ার পরে, লক্ষ্মীপুজোর সাঁঝে, স্কুল মাঠে জমায়েত হয়ে কুশল বিনিময়ের পর চলল কোলাকুলি। বিবাহিতারা পরস্পরকে সিঁদুরে মাখিয়ে দেওয়ার পরে মঙ্গল কামনা। আর। তার পরেই শুরু হল পুরনো ভোজের তোড়জোড়।
দলাদলির পাশাপাশি এই ভোজে মিলে যাচ্ছেনস দিনমজুর পরিবারের লতিকা দাসের সঙ্গে বিত্তশালী ঘরের অনিমা দাসও।
কৃষি প্রধান রাজাগ্রামে অনেকেই চাকরি সূত্রে বাইরে। গ্রামে ফেরেন পুজোর ছুটিতে। বহু পরিবারেই আসেন মেয়ে, জামাই, আত্মীয় কুটুম্বরা। একে অন্যের বাড়িতে যান বিজয়া সারতে। আবার সময়ের অভাবে যাওয়া না হলে বিজয়ার রাতে দেখাও হয়ে যাচ্ছে ঠিক।
যার শুরুটা হয়েছিল গ্রামের দুই প্রবীণ, দ্বিজপদ দাস আর তারেশ চন্দ্র দাসের উদ্যোগে। ৫১ বছর আগের সে দিন গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছিল দ্বিজবাবুর ডাকা সভায়। আজও মনে আছে গ্রামবাসীদের। দ্বিজবাবু বলেছিলেন, সারা বছর ধরে এক সঙ্গে গ্রামে থাকতে গেলে নিজেদের মধ্যে ঠোকাঠুকি তো লাগেই। তা নিয়ে বাড়ে মনোমালিন্য, অশান্তিও। মনের মধ্যে ক্ষোভও পুষে রাখে অনেকে। তাকে মুক্তি দিতেই এই আয়োজন।
সেই ভাবনা থেকেই সেদিন তাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে গ্রাম কমিটি। সেই থেকে প্রতিবছর ২৫ জনের গ্রাম কমিটি গড়েই চলছে এই উৎসবের আয়োজন।
কমিটির বর্তমান সভাপতি সিপিএম নেতা সুশান্তবাবু বলেন, “আমি তখন কলেজে পড়ি। ১৯৬৬ সাল। সেই বছর আগে গ্রামের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন গ্রামে শুরু হয় বিজয়া উৎসব শুরু।” কমিটির সম্পাদক, কংগ্রেসের কৃষ্ণধন দাস বলেন, “এক সঙ্গে মেলামেশা, কুশল বিনিময়, মন থেকে বিদ্বেষ মুছে দেয়। গ্রামে আর কি আছে বলুন, একটু কাছাকাছি থাকার ইচ্ছে নিয়েই এই আয়োজনটা টিঁকিয়ে রেখেছি আজও।”
বিজয়ার সাঁঝে, পারস্পারিক সেই আঁকড়ে থাকা নিয়েই বাঁচতে চায় রাজানগর।