কমল হাসন ও দীপিকা পাড়ুকোনের সঙ্গে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা জানালেন শাশ্বত। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: যদি বলি আপনি সফল বলিউড অভিনেতা যিনি বাংলায় অভিনয় করছেন…
শাশ্বত: (হেসে) কথাটা মন্দ নয়। তবে আমার কোনও কাজ সফল হলে আমি ভুলে যাই। মনে হয়, এই তো গতকালই ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছি। কাজেই আমায় আরও ভাল কাজ করতে হবে। কী করেছি সেগুলো মাথায় বেশি চেপে বসলে মাটি থেকে পা উঠে যাবে।
প্রশ্ন: অভিনেতা হিসাবে আপনার পরিসর আরও বড় হয়েছে। অমিতাভ বচ্চন, কমল হাসন, দীপিকা পাডুকোন, রণবীর কপূর…
শাশ্বত: আমরা যে বড় বড় নামগুলো শুনি, তাঁরা আমাদের থেকে অনেক বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধ। কমল হাসন, অমিতাভ বচ্চন, দীপিকা কখনও দেরি করে সেটে পৌঁছন না। আমি দেখেছি, কমল স্যর শট দিয়ে ফ্লোরে বসে রয়েছেন। যত ক্ষণ না পর্যন্ত পরিচালক বলছেন, “স্যর আপনি ভ্যানে গিয়ে বিশ্রাম করুন। আপনার শট আধ ঘণ্টা পরে”, উনি ওখানেই থাকছেন। তার পর অনিচ্ছাকৃত ভাবেই ভ্যানে চলে যাচ্ছেন। বাকি সময় কিন্তু ফ্লোরেই।
প্রশ্ন:অমিতাভ বচ্চন?
শাশ্বত: উনি কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। আর বাকি সময় ওঁকে দেখেছি মোবাইলে ডুবে থাকেন। সব কিছুর খবর রাখেন। মোবাইল ওঁর কাছে পৃথিবী। মোবাইল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেই বই পড়তে থাকেন।
প্রশ্ন: কিন্তু আপনি মোবাইলকে ‘বাই’ (বিদায়) করতে পারলে বেঁচে যান…
শাশ্বত: এই তো আপনার সঙ্গে কথা বলছি, মোবাইল গাড়িতে।
প্রশ্ন: এখন তো তা-ও সমাজমাধ্যমে দেখা যায় আপনাকে…
শাশ্বত: ওটা বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে। নইলে নকল প্রোফাইল থেকে অনেক কিছু হচ্ছিল। পুলিশের পরামর্শে সমাজমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলেছি। আমাকে বলা হয়েছে, “আপনার নিজের প্রোফাইল খুলুন। তাতে নীল রঙের দাগ থাকবে এবং মানুষ বুঝবে যে এটা আপনার প্রোফাইল। আপনার নামের নকল পেজ থেকে অনেক রকম কাণ্ড ঘটছিল।” যা-ই হোক, মুম্বই নিয়ে কাজের কথায় আমি মাধুরী দীক্ষিতের কথাও বলতে চাই।
প্রশ্ন: বলুন না…
শাশ্বত: মাধুরী দীক্ষিতের সঙ্গে বিজ্ঞাপনী শুটিং করতে গিয়েও দেখলাম পোশাক বদলানো আর বাথরুমে যাওয়া ছাড়া তিনি কিন্তু মেকআপ ভ্যানে যাচ্ছেন না। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে তো ভ্যান থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ডেকে আনতে চারটে লোক লাগে।
গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রশ্ন: বাংলা ইন্ডাস্ট্রির পরিধি কি ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে?
শাশ্বত: একটা সময় তো অনেক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই পরিধি তো ছোট হয়েছেই। কিন্তু হ্যাঁ, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ইন্ডাস্ট্রি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
প্রশ্ন: নবাগতেরা একটানা কাজ করতে পারছেন না…
শাশ্বত: আমাদের সময়ে আমি শুরু করেছিলাম থিয়েটার দিয়ে। কিন্তু এখন ক’জন থিয়েটার দিয়ে শুরু করছে? ওই পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যেতেই চাইছে না অধিকাংশ নতুন শিল্পী।
প্রশ্ন: থিয়েটার দিয়ে শুরু করতেই হবে?
শাশ্বত: না, তা কেন?এর অন্য একটি দিকও রয়েছে। অনেকে প্রতিভা নিয়েই জন্মেছেন। তাদের খুঁজে পেতে বা যথাযোগ্য জায়গা দিতে সেই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে সুযোগ দিতে হবে। এটা কিন্তু পরিচালক-প্রযোজকদের হাতে।
প্রশ্ন: শাশ্বত, অনির্বাণ, পরমব্রত, যীশুর পরে একটানা কাজ করছেন, এমন নতুন অভিনেতা কোথায়?
শাশ্বত: আসলে আমরা যে সময় কাজ শুরু করি, তখন ধারাবাহিকে পুরুষ চরিত্রের অভিনয় করার জায়গা ছিল। কিন্তু এখন কোনও মেগায় পুরুষ চরিত্রের সে ভাবে গুরুত্ব নেই। এখন দেখতে-শুনতে ভাল হলে, পেশিবহুল সুঠাম চেহারা হলেই ধারাবাহিকে পুরুষ অভিনেতা নায়িকার বরের চরিত্র পেয়ে যাচ্ছে। সেখানে তাদের শেখার জায়গাটা নেই। আগে চিত্রনাট্য পড়া, দৃশ্য কী ভাবে আরও ভাল করা যায় তাতে সময় দেওয়া হত। কিন্তু এখন সেই সময়টাই নেই কারও কাছে। কী ভাবে শিখবে নতুন প্রজন্ম? একটা সফল ধারাবাহিক, তার পর আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে!
প্রশ্ন: কলকাতায় তো বাছাই করে কাজ করছেন, এই ছবিতে কেন কাজ করলেন?
শাশ্বত: বহু বছর আগে আমি তখন আমেরিকায়। ভানু জেঠুর ছোট ছেলে আমার সঙ্গে আলাপ করে বলেছিলেন, “আমার খুব ইচ্ছে, যদি বাবাকে নিয়ে কখনও কাজ হয়, তুমি কোরো সেটা। কারণ কিছু কিছু জায়গায় বাবার সঙ্গে তোমার মিল খুঁজে পাই।” আমার কাছে যখন সুযোগ এল রাজি হয়ে যাই আমি। তবে বাড়ির একটা চাপ ছিল।
প্রশ্ন: বাড়ির চাপ কেন?
শাশ্বত: অভিনেতার বাড়ির সকলের ভাল লাগবে কি না তা দেখতে হবে তো। ছেলেমেয়েরা আমাকে সেই চরিত্রে পছন্দ করছে কি না সেটাই তো প্রথম। স্পেশ্যাল স্ক্রিনিংয়ে তাঁরা ছবি দেখে উচ্ছ্বসিত। আমি একটু হলেও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি।
প্রশ্ন: এই ছবির একটি গান নিয়ে মানুষের ভাল লেগেছ…
শাশ্বত: আমরা তো পুরনো গানটাই দিতে চেয়েছিলাম। কপিরাইটের জন্য সংলাপ, গান নতুন করে লিখতে হয়েছে। আজকাল এত ঝামেলা! ‘মাসিমা মালপো খামু’র জায়গায় ‘পিসিমা মালপো খামু’ দিতে হয়েছে। যাই হোক, চেষ্টা করেছি যতটা পেরেছি।
প্রশ্ন: উত্তমকুমারকে কাছ থেকে দেখেছেন। দর্শক তাঁর সঙ্গেও তো আপনার মিল খুঁজে পান…
শাশ্বত: উত্তমকুমার, ভানু, ওঁদের কাজ এত বেশি প্রভাব ফেলেছে। তাঁদের বিশেষ ধরন দেখা গিয়েছে পর্দায়। যা দেখে আমরা বড় হয়েছি। তাই আমাদের রক্তে প্রবেশ করেছে সেই ধরন।
প্রশ্ন: উত্তমকুমার নায়ক, ভানু কৌতুক অভিনেতা। এই যে আলাদা করে দেখা, মানতে পারেন?
শাশ্বত: আমি এই ভাবে দেখিই না বিষয়টিকে। একজন অভিনেতাকে অভিনেতা হিসাবেই দেখি। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় গম্ভীর চরিত্রের জন্য যে কতটা উপযোগী তা তাঁর দুটো ছবি থেকে জানা যায়। ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ছবিতে ভানু জেঠু ও তাঁর ছোট মেয়ে অভিনয় করেছিলেন। কাঁদিয়ে দিয়েছিলেন। আরও একটি ছবি, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ ছবিতে ভানু জেঠুকে যে ওই ধরনের চরিত্রে ভাবা যেতে পারে তা কল্পনাতীত ছিল। আবারও অভিনয় দিয়ে কাঁদিয়ে দিলেন তিনি। তাই শুধু কৌতুক অভিনেতা বলে বেঁধে রাখা যাবে না ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তা ছাড়া, কৌতুক অভিনয় কিন্তু কঠিন । একটা সরু দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে ভাঁড়ামোটা করতে হয়।
প্রশ্ন: আপনি প্রায়শই বলেন, খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করলেও, কৌতুক চরিত্রের দিকেই পছন্দের পাল্লা ভারী?
শাশ্বত: হ্যাঁ, কারণ মানুষ হাসতে ভুলে যাচ্ছে আজকাল। চারপাশে যা ঘটছে তাতে করে মানুষের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনা খুব জরুরি। তাই ‘কমেডি’ই সব থেকে ভাল বিকল্প বলে মনে হয় আমার।
প্রশ্ন: ‘কল্কি’র সিকুয়েল আসছে…
শাশ্বত: আমি তো মারা গিয়েছি। প্রভাস অত বড় ত্রিশূল দিয়ে মেরে ফেললেন আমাকে! এর পর কমল হাসন মূল খলনায়ক হবেন।
গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রশ্ন: আপনার সমাজমাধ্যমে ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হতাশ?
শাশ্বত: বিশ্বে নানা জায়গায় এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। ফলে এক-দু’দিনে এটা বদলানো সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: একজন পুরুষের জায়গা থেকে কী মনে হয়, শুধুই মানসিকতায় গলদ?
শাশ্বত: আমি তো মা-বাবাকে বেশি দোষারোপ করব। কোথাও লালনপালনে গলদ থেকে যাচ্ছে না তো?
তা ছাড়া, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যাতে তারা ভয় পায়। ভয় না দেখাতে পারলে কোনও দেশেই কোনও কাজ হয় না। ধরুন, সিঙ্গাপুর। ওখানে এত নিয়ম মেনে চলা হয়। ওখানে কেউ একটা আইন ভেঙে দেখাক তো! একটা বাড়তি হর্ন দিলে চালক সোজা জেলে!
প্রশ্ন: মেয়ে তো মডেলিংয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন?
শাশ্বত: হ্যাঁ, কী সব করছে।
প্রশ্ন: মনে হয় না, ও এটা করুক বা ওটা করলে ভাল?
শাশ্বত: না। ও তো প্রাপ্তবয়স্ক। ওর জীবনটা ওর। তবে ওর যদি কোনও রকম সহায়তার প্রয়োজন পড়ে, আমি আছি। যতটুকু আমার ক্ষমতা আমি সমর্থন করব। মডেলিং অথবা অভিনয়, যা-ই করুক।
প্রশ্ন: আপনি একজন জাত অভিনেতা, কিন্তু নায়ক হতে পারেননি?
শাশ্বত: না, আমার নায়কসুলভ চেহারা নয়। আমি কখনও হতে পারিনি সে রকম।
প্রশ্ন: প্রথম থেকেই এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল আপনি?
শাশ্বত: হ্যাঁ। একজন অভিনেতাকে জানতে হয় সে কী পারে না। তা হলেই সে সফল অভিনেতা হতে পারে। ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কহানি’ হাতজোড় করে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম কর্ণ জোহরকে। নাচ করতে হবে, আমি তা পারব না। দেড় মাস তালিম নিয়ে আমাকে নাচ শিখতে বলেছিলেন। আমি বলেছিলাম, দেড় মাসের তালিম নিয়ে শাস্ত্রীয় নৃত্য শেখা যায় না। এমনি সিনেমার নাচ হলে শিখে নেওয়া যেত। প্রতিটা আঙুলের মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ। দশ-বারো বছর লাগে শিখতে। তাই ছবিটা না করে দিয়েছিলাম এবং টোটা করেছে। টোটা আরও ভাল করেছে।
প্রশ্ন: অনেকে বলেন, অবাঙালি প্রযোজক দেখলে নাকি আপনি রেগে যান?
শাশ্বত: না, রেগে যাই না আমি। আমি চাই, প্রযোজকেরা একটু বাংলা সাহিত্য পড়ুক। বাংলা সাহিত্যের রত্নভান্ডার সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। এ দিকে মুম্বই ও দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে কোথায় কী দুটো ছবি সফল হয়েছে বলে সেই ছকে তো আমি বাংলা ছবি বেঁধে দিতে পারি না! বাংলা ছবি চালাতে গেলে বাঙালিদের মন বুঝতে হবে। লাথি মেরে দুমদাম করে চারটে দরজা ভেঙে দিল! খুব কম বাঙালি সিটি দেবেন এই দৃশ্য দেখে। অনুভূতিতে নাড়া দিতে না পারলে ভাল ছবি বলা যাবে না। শুধু পাকামো করলে হবে না। আমি কতটা জানি সেটা দেখানোটাই সিনেমা নয়। আমার জ্ঞান দেখতে বা শুনতে ছবি দেখতে যাবে না দর্শক।